লিচ থেরাপি: সম্রাট অশোকও যেভাবে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন জোঁক দিয়ে


মনে করুন, আপনি অনেক অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার আপনাকে জানালেন যে, আগামীকাল সকালে আপনাকে লিচ থেরাপি দেওয়া হবে। অজানা এই নামটা শোনার পর আপনি ধরে নিলেন এটি হয়তো আধুনিক কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিই হবে।
পরের দিন যথারীতি ডাক্তার আপনার কক্ষে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তার সাথে কোনো ভারী যন্ত্র বা অন্য কোনো চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই। ডাক্তারের পেছন পেছন একজন নার্স প্রবেশ করেছেন। তার হাতে একটা বড় বয়াম। বয়ামের ভিতরে কী আছে উকি দিতেই আপনি একেবারে আঁতকে উঠলেন। বয়াম ভর্তি জোঁক কিলবিল করছে। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই ডাক্তার এক এক করে জোঁকগুলো আপনার শরীরের উপর রাখতে শুরু করলেন। আপনার অপ্রস্তুত চেহারা দেখে ডাক্তার আপনাকে আভাস দিয়ে বললেন, এটিই লিচ থেরাপি!

লিচ থেরাপির ইতিহাস

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অনেক বেশি যন্ত্র নির্ভর। কিন্তু এই যন্ত্রগুলো যখন ছিল না, তখনও মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হতো। প্রাচীনকালে চিকিৎসকগণ তাই নানা প্রাকৃতিক উপাদানের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। এই লিচ থেরাপি সেই প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মাঝেই একটি। আর এই পদ্ধতির বয়স নেহায়েত কম নয়।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে, প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম জোঁক ব্যবহার করে চিকিৎসার নমুনাপাওয়া যায়। এছাড়া হিন্দু পুরাণেও এমন চিকিৎসা পদ্ধতির উল্লেখ আছে। মধ্যযুগে লিচ থেরাপি একটি অতি পরিচিত চিকিৎসার কৌশল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে ফেলে। তখন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের শরীরের ভিতরের অংশ ফুলে গেলে কিংবা রক্ত জমাট বেঁধে গেলে লিচ থেরাপি ব্যবহার করা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান চিকিৎসকগণ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নানা রোগের চিকিৎসা করতে থাকেন। ১৯৮০ সালের দিকে এই পদ্ধতিটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে এবং প্লাস্টিক সার্জনরা এটি প্রয়োগ করতে শুরু করেন। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন রোগ, যেমন– উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন রোগ, অস্বাভাবিক রক্তপাতজনিত নানা রোগ, এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এই লিচ থেরাপি ব্যবহার করা শুরু হয়। এছাড়া কসমেটিক সার্জারি ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সার্জারির সময় রক্তপ্রবাহ শিথিল করতে লিচ থেরাপি বিরাট ভূমিকা পালন করে।

জোঁক দিয়ে আবার কেমন চিকিৎসা?

প্রশ্নটা আসলে যৌক্তিক। অনেকের মনে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু যেহেতু এই পদ্ধতিটি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেহেতু এর পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণ অবশ্যই রয়েছে। আসলে জোঁকেরও নানা প্রজাতি রয়েছে। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র একটি প্রজাতিকে চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এই প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম হিরুডো মেডিসিনালিস (Hirudo medicinalis)। এই নাম থেকেই বোঝা যায় যে, এর সাথে মেডিসিনের যোগসূত্র রয়েছে। প্রথমে এই জোঁক দিয়ে কেবল শরীরের দূষিত রক্ত পরিষ্কার করা হতো। দেহের অভ্যন্তরে শিরায় পুঁজ সৃষ্টি হয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে, জোঁক ব্যবহার করে উক্ত স্থানে রক্তের প্রবাহ শিথিল করা হতো। কিন্তু এখন হৃদরোগসহ অন্যান্য নানা রোগের চিকিৎসায় জোঁক ব্যবহার করা হয়।
হিরুডো মেডিসিনালিস নামক জোঁকের দুই সারিতে ছোট ছোট দাঁত বিশিষ্ট তিনটি চোয়াল রয়েছে। এই দাঁতগুলো চিকিৎসারত ব্যক্তির চামড়ায় আঁকড়ে ধরে রক্ত শোষণ করতে থাকে। নিজে রক্ত নেওয়ার প্রতিদানস্বরূপ এরা ঠিকই কিছু উপকারি উপাদান রোগীর দেহে দান করে যায়। প্রথমেই এদের দেহ হতে নির্গত হয় একধরনের অ্যানেসথেটিক তরল। এটি জোঁকের কামড়ে ধরা জায়গাটি অবশ করে ফেলে। এর কারণেই আমরা বর্ষা-বাদলের সময় পায়ে জোঁক ধরলে টের পাই না। এছাড়াও জোঁকের লালা থেকে হিরুডিন নামক একটি এনজাইম রোগীর দেহে প্রবেশ করে। অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট সমৃদ্ধ এই এনজাইম রক্ত বিশুদ্ধিকরণ ও অন্যান্য নানা রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি জোঁক সর্বোচ্চ ১৫ মিলিলিটার পর্যন্ত রক্ত শোষণ করতে পারে। শরীরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বেশ কয়েকটি জোঁক স্থাপন করা হয়। এরা যাতে কামড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা স্থান পরিবর্তন না করে, সেজন্য এদের গ্লাস চাপা দিয়ে রাখারও নমুনা রয়েছে। এভাবে একটি থেরাপি চলতে সাধারণত ২০-৪৫ মিনিট সময় লাগে। রোগের ধরন অনুযায়ী এই থেরাপির বিভিন্ন সেশন বা সময়কাল রয়েছে। কামড়ে ধরা স্থান থেকে জোঁকগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর ইংরেজি ওয়াই (Y) অক্ষরের মতো ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেয়। এই দাগ সময়ের সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। চামড়ায় কোনো স্থায়ী ক্ষত তৈরি হয় না।
বিভিন্ন কঠিন রোগের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো, এর পেছনে খরচ তুলনামূলক কম এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

যেসব রোগের চিকিৎসায় লিচ থেরাপি ব্যবহার করা হয়

জোঁক যেহেতু রক্ত শোষণ করে, সেহেতু বিভিন্ন রক্তপ্রবাহজনিত রোগের চিকিৎসায় লিচ থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া জোঁকের লালায় বিভিন্ন উপকারী রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। এগুলো অন্যান্য নানা রোগের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি জোঁকের লালা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করছে। শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গ অবশ করার জন্য কিংবা ফুলে যাওয়া রোধ করার জন্য এই ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন বড় বড় রোগের চিকিৎসায় লিচ থেরাপি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
হৃদরোগ
যেহেতু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ সরাসরি দেহের রক্ত প্রবাহের সাথে জড়িত, তাই হৃদরোগের চিকিৎসায় লিচ থেরাপি ব্যবহার করা হয়। অনিয়মিত ও অস্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ, শিরা ও ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধা ইত্যাদি রোধে লিচ থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ক্যান্সার
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় লিচ থেরাপির প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। যদিও ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন, তবে গবেষণা অনুযায়ী ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রভাব কমিয়ে আনতে এই থেরাপি সফল হয়েছে। গবেষণায় ইঁদুরের মধ্যে সরাসরি জোঁকের লালা প্রবেশ করিয়ে দেখা গেছে, তা দ্রুত ক্যান্সার কোষ বিনষ্ট করতে সক্ষম।
মেক্সিকান প্রজাতির এক জোঁকের (Haementeria officinalisলালায় অ্যানটিস্টাসিন নামক একধরনের প্রোটিন রয়েছে, যা ফুসফুসের ক্যান্সার পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। গবেষকরা আরো বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক পরীক্ষা করে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার পথ অনুসন্ধান করছেন।
কসমেটিক সার্জারি
বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষের নাক, গাল, কপাল ইত্যাদি বিকৃত হয়ে যেতে পারে। কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে এগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সার্জারির পর চামড়ার টিস্যুগুলোর মধ্যে রক্ত জমাট বা ক্লট সৃষ্টি হতে পারে। এই ক্লট দূর করার একটি সহজ ও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে লিচ থেরাপি ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মাথার তালুতে লিচ থেরাপি প্রয়োগ করলে চুল পড়া বন্ধ হয়। এভাবে সার্জারির পর বিভিন্ন অঙ্গের রক্ত প্রবাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে এবং কোনো জটিলতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য লিচ থেরাপি পুরোপুরি প্রাকৃতিক এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন কৌশল।
ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন শরীরের বাহুগুলো, যেমন- হাত, পা, আঙ্গুল ইত্যাদিতে রক্তপ্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং পচন ধরতে শুরু করে। এসময় অ্যাম্পুটেশন বা পচন ধরা অঙ্গটি কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এই ভয়ানক পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লিচ থেরাপি ব্যবহার করা যায়। জোঁকের লালার সাথে বের হওয়া হিরুডিন নামক উপাদান রক্ত শিথিল করে স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করে। সম্প্রতি একটি পরীক্ষামূলক অপারেশনে লিচ থেরাপির মাধ্যমে ষাট বছর বয়সী এক ডায়াবেটিস রোগীর পা কাটা যাওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কিছু চীনা থেরাপিস্ট এক বিশেষ প্রজাতির জোঁক (Whitmania pigra) ব্যবহার করে এমন ফলাফল লাভ করেছেন।
দন্ত চিকিৎসা
বিভিন্ন দন্ত বিষয়ক অস্বাভাবিকতা, যেমন– চোয়ালের ব্যথা, মাড়ি ফুলে যাওয়া ইত্যাদির চিকিৎসায় লিচ থেরাপির প্রয়োগ ঘটে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ফেসিয়াল সার্জারির পাশাপাশি দন্তচিকিৎসায় এই থেরাপি কাজে লাগানো হয়।

শেষ কথা

লিচ থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। তবে বিপদের আশঙ্কা পুরোপুরি ব্যক্তি নির্ভর। এই ধরুন, কারো যদি জোঁকের লালারসে অ্যালার্জি থাকে, তবে তার উপর লিচ থেরাপি প্রয়োগ করা উচিত নয়। অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই যে জোঁকগুলো ব্যবহার করা হবে, তা যাতে চিকিৎসক কর্তৃক অনুমোদিত হয়, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।
লিচ থেরাপি একেবারে শতভাগ প্রাকৃতিক এবং স্বল্পখরচের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই কোনোদিন এই থেরাপির সম্মুখীন হলে ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। দেখতে উদ্ভট মনে হলেও এই থেরাপির উপকারিতা অনেক এবং খরচও তুলনামূলক কম।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.