যেখানে বাঙালিদের আজও দাস বানিয়ে রাখা হয়, প্রতিদিন চলে উলঙ্গ করে মার



সাজাদ মিঞাঁ কোনো ক্রমে বেঁচে ফিরেছে। কিন্তু ওর মতো আরও অনেকে রয়েছে যাঁরা বেঁচে ফিরতে পারে না। থাইল্যান্ডে কাজ করতে নিয়ে যাওয়ার নামে প্রতিনিয়ত পাচার করে দেওয়া হচ্ছে দুই বাংলার হাজার হাজার মানুষকে। কারও মৃত্যু ঘটছে ওখানেই। মাটিতেও নয় মাঝ সমুদ্রে মরে যাচ্ছে হাজার হাজার বাঙালি। বিশেষত বাংলাদেশ থেকে এদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ডে।

২০১৩ সালে চাইরেত রেতচাপাকসি নামের এক যুবক থাইল্যান্ডের একটি মৎস্য শিকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। আর দশজনের মতো তারও উদ্দেশ্য ছিল এই চাকরির মাধ্যমে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো। রেতচাপাকসি এখন চল্লিশে পা দিয়েছেন, বাড়ি থাইল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলীয় ফেটচাবুরি প্রদেশে। একদিন পার্শ্ববর্তী প্রদেশ সামট সং ক্রমে কাজের সন্ধানে যান তিনি। সেখানে একটি নৌকায় জেলে হিসেবে চাকরি পান। 
 
রেতচাপাকসি বর্তমানে 'থাই অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট ফিশার্স ইউনিয়ন গ্রুপ (টিএমএফজি)' নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জেলে জীবনের সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা সেখান থেকে পালানোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবাই মিলে ইন্দোনেশিয়ার থাই রাষ্ট্রদূতের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো জবাব পাইনি। আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কারো কোনো তৎপরতাও লক্ষ্য করিনি। একপর্যায়ে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন ভাবতাম, কে আমাদের মুক্ত করবে? ধীরে ধীরে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।   


স্থানীয় এনজিও এলপিএন ২০১৫ সালে জেলেদের সুরক্ষায় একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সেসময় তারা টিএমএফজি প্রকল্পের আওতায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ ও ট্রলারগুলো মনিটরিং করতো এবং সন্দেহভাজন জাহাজ ও নৌকাগুলোকে চিহ্নিত করে রাখতো। কিন্তু সংস্থাটির মতে, নিয়মিত মনিটরিং করা, সেই অনুযায়ী অভিযান চালানো এবং জেলেদের নিরাপত্তা প্রদান বেশ ব্যয়বহুল ও জটিলতাপূর্ণ কাজ, যা তাদের পক্ষে পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। 

এভাবেই জীবন যুদ্ধ করে যেতে হয় পাচার হয়ে যাওয়া বাঙালি দাস জেলেদের, Image Source: Aljazeera
 

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু  মানুষ আজও আটকে আছেন এই থাইল্যান্ডের নরকে। সে এক সাংঘাতিক রোমহর্ষক চিত্র। স্যাঁতস্যাঁত আবহাওয়ার মাঝে মশার কামড় অর্ধেক অসুস্থ তাদের এমনই করে দেয়। তার ওপর এই ধরনের অত্যাচার তাদের জীবনকে আরও কষ্টে ভরিয়ে তোলে। মাছের ট্রলারে কেটে যায় তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়। মাঝ দরিয়াতে দুর্ঘটনা ঘটলে নিজের গাঁয়ের মাটি পর্যন্ত তাদের কপালে জোটেনা।

সদ্য উদ্ধার হওয়া এক বাংলাদেশি জেলে নামাজ পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে, Image Source: Aljazeera

 
থাইল্যান্ডের মৎস্য বিভাগ একাই ৮২ প্রকারের সি-ফুড বিদেশে রপ্তানি করে। এলপিএন এর অনুমান, ১০,০০০-২০,০০০ ফিশিং বোট এই সি-ফুড সংগ্রহ ও প্রসেসিংয়ের সাথে যুক্ত রয়েছে। রেতচাপাকসিকে তিন বছর আগে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করা হয়।এলপিএন সংস্থা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হলে সংস্থাটির পরিচালক পাতিমা ও টিএমএফজি প্রকল্পের একদল সদস্যদের যৌথ অভিযানে রেতচাপাকসিসহ আরও অনেক জেলেকে মুক্ত করেন। পাতিমা সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, আমাদের ধারণা ছিল সেখানে ১০০ জনের মতো দাস জেলে বন্দী আছে, কিন্তু সেখানে অভিযান চালিয়ে আমরা দেখতে পাই প্রায় ১,০০০ দাস জেলে সেখানে বন্দী রয়েছে।    

 

এই ধরনের পুরনো ভেঙে যাওয়া ট্রলারে করেই মাঝ সমুদ্রে পাড়ি দেয় থাইল্যান্ডের দাস জেলেরা, Image Source: Aljazeera


 
 
সূত্র: আলজাজিরার তৈরি তথ্যচিত্র "Slavery at sea"


 




 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.