ঋতু আজও অপরিবর্তিত, জন্মদিনে বঙ্গদেশের রেনেসাঁর জনক


Odd বাংলা ডেস্ক: "সোজা কথাটা সোজা করে বলা", তাঁর মুখে হামেশাই এই একটি বক্তব্য শোনা যেত। চলচ্চিত্রের ভাষা কী হবে সে বিষয়ে তাঁর ভাবধারা আজও বাংলা সিনেমাকে শেখাচ্ছে। বাঙালি যে গরীব জাতি সে বিষয়ে তাঁকে মাঝে মাঝেই বলতে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বাঙালির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক উত্কৃষ্টতা আছে সে বিষয়ে তাঁর মধ্যে একটি গর্বও ছিল চিরদিন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগষ্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুনীল ঘোষ ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পাঠ শেষে চাকরি নেন বিজ্ঞাপন সংস্থায়। লিঙ্গ পরিবর্তন ঋতুপর্ণর জীবনে একটি বিশেষ অধ্যায়। বহু বিতর্কেও তিনি অবিচল থেকে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
দ্য লাস্ট লিয়র ছবির স্যুটিং-এ ঋতুপর্ণ, Image Source: Google
স্বল্পায়ু জীবনে তার সর্বমোট চলচ্চিত্র ১৯টি।  এ ১৯টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১২টি জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক পরবর্তী বাংলা সিনেমার নতুন এক ধারা তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ। জীবনের নানা অঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁর চরম অধ্যাবসায়ের। কিন্তু দুঃখের বিষয ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় নিছক একজন বিশেষ সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন যুক্ত মানুষ হিসেবে হয়ে দাঁড়ায়। যা খুবই লজ্জার। এবং তিনি যে সত্যি অগ্রগামী এক বাঙালি তা তিনি প্রমান করেছিলেন। একথাটি অস্বীকার করা যাবে না। যে ঋতুপর্ণ ঘোষ সিনেমার বাইরেও বাংলাকে দিয়ে গেছেন আরেকটা জিনিস। আর সেটা হল সাহস। ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম একজন বাঙালি মধ্যবিত্ত যিনি নিজের যৌনতা নিয়ে নিজের ব্যাক্তিসত্তা নিয়ে প্রথম খোলাখুলি কথা বলেছিলেন। আর তার এই সাহস ছড়িয়ে পড়েছিল বঙ্গদেশে। বহু সমসাময়িক ব্যাক্তির রোল মডেল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অনেক সমকামি মানুষ তাঁকে দেখে নিজেও আত্মপ্রকাশ করে। ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিনে তাই একথাটি উল্লেখ না করলে ভুল করা হবে। 
 


 
মেকআপের ফাঁকে ঋতুপর্ণ ঘোষ, Image Source: Google 

 
বাংলার চলচ্চিত্রের দিকে যদি তাকায় তাহলে একথাটিও বলা দরকার যে বাংলা সিনেমা যখন প্রায় ব্যবসার চাপে নিজের ভাষা হারাচ্ছে তখন তিনিই প্রথম সেই হাল টেনে ধরেছিলেন। প্রায় প্রত্যেকটি ছবিই বাংলা সিনেমাকে দিয়েছিল বিশেষ রূপ। কিন্তু বহু ছবিই দর্শকের আড়ালে থেকে গেছে। কারন অনেক ছবিই তো মহাফেজখানাতে কেবল ক্যান বন্দি থেকেছে।

১৯৯২- হীরের আংটি ১৯৯৪- উনিশে এপ্রিল ( জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী- দেবশ্রী রায়)
১৯৯৭- দহন ( জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ স্ক্রিন প্লে, জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী- ইন্দ্রাণী হালদার, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত)
১৯৯৯- বাড়িওয়ালি ( জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী-কিরণ খের, শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী- সুদীপ্তা চক্রবর্তী)
১৯৯৯- অসুখ ( জাতীয় পুরস্কার- বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ সিনেমা)
২০০০- উৎসব ( শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার)
২০০২- তিতলি
 ২০০৩- শুভ মহরত (জাতীয় পুরস্কার- বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সিনেমা, শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী- রাখী)
২০০৩- চোখের বালি ( জাতীয় পুরস্কার- শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা)
২০০৪- রেইনকোট ( হিন্দি ভাষায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার)
২০০৫- অন্তরমহল
 ২০০৬- দোসর ( জাতীয় পুরস্কার, বিশেষ জুরি পুরস্কার- প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী)
২০০৭- দ্য লাস্ট লিয়র ( ইংরেজি ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার)
২০০৮- খেলা ২০০৮- সব চরিত্র কাল্পনিক (জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা)
২০১০- আবহমান ( জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক, বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার)
২০১০- নৌকাডুবি
 ২০১২- সানগ্লাস
২০১২- চিত্রাঙ্গদা ( বিশেষ জুরি পুরস্কার, অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ)

তবে সিনেমার বাইরে ঋতুর রূপ আরও অনন্য ছিল। একটি বিশেষ সাক্ষাতকারে অঞ্জন দত্ত ঋতুপর্ণঘোষ সম্পর্কে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। তিনি বলছেন ২০১০ সালে আমার এক বন্ধু দার্জিলিং থেকে কলকাতাতে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে এসেছিলেন। সেসময় সেই ব্যাক্তিকে থাকার জায়গা করে দেওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক মাস থাকতে হতো কলকাতাতে। ঋতু কিছু জিজ্ঞাসা না করেই তাঁর যোধপুর ফ্ল্যাটের চাবিটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলো। এই ঘটনা অন্তত প্রমান করে যে কত বড়ো মাপের ও মানষিকতার মানুষ হলে তবেই এই কাজ করা সম্ভব। তাঁর জীবনের প্রতিটা অঙ্গেই আপনি পেতে পারেন এমন অনেক ঘটনার প্রমান।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.