বব মার্লে, গাঁজার রাজা নাকি তৃতীয় বিশ্বের প্রথম সুপারস্টার?


Odd বাংলা ডেস্ক: বব মার্লে ছিলেন তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসে প্রথম সুপারস্টার। ৭০ এর দশকে যিনি শ্রোতা-দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন তার নান্দনিক সুরের মূর্ছনায়। একাধারে তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী। তিনি গেয়েছেন এবং তৈরি করেছেন রেগি, স্কা, রক স্টেডি সহ নানা ধরনের মৌলিক এবং মিশ্র সঙ্গীত। বব মার্লে জ্যামাইকান সঙ্গীতকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, করে তুলেছেন জনপ্রিয়। মার্লের গানে এমন কিছু ছিল, যা শ্রোতাদেরকে তাদের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে সুরের তালে নেচে উঠতে বাধ্য করতো।
বব মার্লে ১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ জ্যামাইকার নাইন মাইল নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা নর্ভাল মার্লে ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ জ্যামাইকান এবং মা সেডেলা বুকার ছিলেন আফ্রো-জ্যামাইকান। ববের পারিবারিক নাম রবার্ট নেসটা মার্লে। ১৯৫৫ সালে ববের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। তার পিতার মৃত্যুতে তাদের পরিবারের উপর অসহনীয় অর্থনৈতিক সংকট নেমে আসে।
মার্লে এবং নেভিল লিভিংস্টোন (পরবর্তীতে যিনি বানি ওয়েইলার নামে পরিচিত হোন) ছিলেন ছোটবেলা থেকে বন্ধু। তারা প্রায়ই একসাথে গান-বাজনা করা শুরু করেন। বব মার্লে বারো বছর বয়সে তার মার সাথে নাইন মাইল ছেড়ে পাড়ি জমান ট্রেঞ্চটাউন, কিংস্টনে।
ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে বব ‘জাজ নট’, ‘ওয়ান কাপ অব কফি’, ‘ডু ইউ স্টিল লাভ মি?’ এবং ‘টেরর’ শিরোনামে চারটি গান রেকর্ড করেন ফেডারেল স্টুডিওজে। এর মধ্যে ‘ওয়ান কাপ অব কফি’ নামের গানটি মার্লে 'বব মার্টেল' ছদ্মনামে প্রকাশ করেন।
জামাইকাতে বব মার্লে, দুর্লভ ছবি, Image Source: bobmarleyfoundation

১৯৬৩ সালে বব মার্লে, বানি ওয়েইলার, পিটার টস, জুনিয়র ব্রেইথওয়াইটে, বেভারলি কেলসো, আর চেরি স্মিথ মিলে তৈরি করেন 'টিনেজারস' নামক একটি গানের দল যা পরে তারা বদলে নাম দেন 'ওয়েইলিং রুড বয়েজ' এরপরে আবার নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'ওয়েইলিং ওয়ারিয়রস'। তাদের এই গানের যাত্রায় একসময় সঙ্গীত প্রযোজক কক্সন ডোড তাদের আবিষ্কার করেন এবং এই দলের একটি একক গান ‘স্লিমার ডাউন’ জ্যামাইকার ১৯৬৪ সালে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত রেকর্ডের তালিকায় স্থান পায়। এই গানের রেকর্ডটি প্রায় ৭০,০০০ কপি বিক্রি হয় জ্যামাইকা জুড়ে।
এরপর জ্যামাইকান বিখ্যাত শিল্পী আর্নেস্ট রাংলিন, কিবোর্ডিস্ট জ্যাকি মিট্টো, সেক্সোফোনিস্ট রোনাল্ড আলফানসো সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সাথে ববরা কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু ১৯৬৬ সালে ব্রেইথওয়াইটে, কেলসো আর স্মিথ গানের দল ওয়ারিওরস ছেড়ে চলে গেলে বব, বানি আর পিটার এই তিনজন শুধু বাকি থাকেন দলে।
১৯৭২ সালে মার্লে সিবিএস রেকর্ডের সাথে যুক্ত হন এবং লন্ডনে জনি নাশ এর যাত্রা শুরু করেন। একই বছর ক্রিস ব্ল্যাকওয়েল ওয়েইলারসদেরকে তার আইসল্যান্ড রেকর্ডস এর সাথে কাজ করার প্রস্তাব দিলে মার্লেদের দল এতে রাজি হয় এবং প্রথম এ্যালবাম ‘ক্যাচ অ্যা ফায়ার’ ১৯৭৩ সালে বিশ্ব জুড়ে প্রকাশ করা হয়।
ভক্তদের সঙ্গে বব, Image Source: Google

অ্যালবামটি বব মার্লেকে স্টার বানাতে না পারলেও তার কাজের সীমাকে বিস্তৃত করে দেয়, কারণ তার কাজ নিয়ে তখন থেকে বিস্তর ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয়। ওই বছরেরই শেষদিকে ‘বার্নিন’ শিরোনামে অ্যালবাম প্রকাশ পেলে তা মার্লেকে খ্যাতি এনে দেয়। ‘বার্নিন’ এর একটি গান ‘আই শট দ্য শেরিফ’ গানটির কভার করেন এরিক ক্ল্যাপটন। এই গানটাই ববের প্রথম ইউএস হিট হিসাবে গণ্য হয়। চারিদিকে বব মার্লের নাম ছড়িয়ে দিতে এই কভারটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭৪ সালে 'দ্যা ওয়েইলারস' ব্যান্ড দল ভেঙে যায় এবং এর প্রধান তিন অংশীদার তাদের আলাদা আলাদা ক্যারিয়ার শুরু করেন।
ম্যাডিসন স্কোয়ারে ববের পার্ফর্মেন্স, Video Source: Youtube

১৯৭৬ সালে মার্লের উপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হয় এবং এ ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে সে বছরের শেষভাগে বব জ্যামাইকা ছাড়েন এবং বাহামায় একমাসের যাত্রাবিরতির পর লন্ডনে এসে পৌঁছান। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি ‘এক্সোডাস’ ও ‘কায়া’ শিরোনামে দুইটি এ্যালবাম প্রকাশ করেন। এরমধ্যে ‘এক্সোডাস’ ব্রিটিশ অ্যালবাম লিস্টে ধারাবাহিকভাবে ছাপ্পান্ন সপ্তাহ প্রথম অবস্থান ধরে রাখে। এই অ্যালবামে চারটি ব্রিটিশ সিঙ্গেল হিট ছিল। ‘ওয়েইটিং ইন ভেইন’, ‘জ্যামিং’, ‘ওয়ান লাভ’ এবং ‘পিপলস গেট রেডি’ নামক এই চারটি একক গান তৎকালীন ইউএস হিট লিস্ট লিড দেয়। লন্ডনে বব মার্লেকে একবার গাঁজা রাখার দায়ে গ্রেফতার এবং সাজা দেয়া হয়। তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান দীর্ঘ দুই বছর।
অবশেষে, ১৯৭৮ সালে তিনি জ্যামাইকায় ফিরে আসেন এবং রাজনীতিকে ইতিবাচক দিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তিনি ‘ওয়ান লাভ পিস কনসার্ট’ আয়োজন করেন, যেখানে জ্যামাইকার দুইটি লড়াইরত রাজনৈতিক পার্টির দুই প্রধানকে তিনি এক মঞ্চে নিয়ে আসেন। জ্যমাইকাসহ আফ্রিকানদের কল্যাণে তিনি চিন্তা করেছেন সবসময়।
১৯৬৬ সালে বব মার্লে বিয়ে করেন রিটা অ্যান্ডারসনকে। মূলত তখন থেকেই বব রাস্তাফারি বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি আস্তে আস্তে আনুষ্ঠানিকভাবে রাস্তাফারিজমকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন, এসময় তিনি তার চুলে রাস্তাফারি বিশ্বাস অনুযায়ী লম্বা জটাযুক্ত ঝুঁটি (Dreadlocks) করা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পুরোপুরি রাস্তাফারিয়ানে পরিণত হয়ে যান। তার প্যান আফ্রিকানিজম, রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জীবনাচরণ সবই ছিল তার হৃদয়ের গভীরে ধারণ করা রাস্তাফারিয়ান বিশ্বাসের থেকে উঠে আসা।

তুমি জানো? যখন আমরা ধূমপান করি, তখন সেটা আমাদের মাথা ঠাণ্ডা করে, শান্ত হয়ে বসে ধ্যান করতে সাহায্য করে। বোকা হয়ে বসে থাকার চেয়ে ধ্যান করে অন্য কেউ হয়ে যাও। রাম (মদ) শিক্ষা দেয় মাতাল হতে আর ঔষধি তৃণলতা (তিনি গাঁজাকে ঔষধি তৃণলতা বলতেন) নিজেকে অন্য কেউ ভাবতে সাহায্য করে
বব মার্লে ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। ইন্টারনেটে এখনও তার অসংখ্য ছবি আছে, যাতে তিনি ফুটবল খেলছেন। তার একটি উক্তি ছিল "ফুটবল স্বাধীনতা, একটি পুরো বিশ্ব। আমি এটা খেলতে ভালোবাসি কারণ ফুটবল খেলতে অনেক দক্ষ হতে হয়।" এটা খুব কম লোকই জানে যে, তিনি তার কন্ট্রাক্টে বলে দিতেন যে, তিনি যখনই চাইবেন তখনই যেন ফুটবল খেলা যায়, এরকম ব্যবস্থা রাখতে।
সালটা ছিল ১৯৭৭, তার পায়ের বুড়ো আঙুলের একটা ক্ষত কিছুতেই সারছিল না, তাই তিনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেলে ধরা পড়ে- তিনি ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় চামড়ার ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তাররা তাকে তার পায়ের আঙুল কেটে ফেলতে পরামর্শ দিলেও তিনি তা মেনে নেননি কারণ রাস্তাফারিয়ান বিশ্বাসে তা করার অনুমোদন নেই।
নোমোর ওয়ার গাইছেন বব মার্লে, Video Source: Youtube
তার অসুস্থতার খবর সাধারণ মানুষকে জানতে না দিয়েই তিনি তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। ১৯৭৯ সালে একটি সফল ইউরোপ সফরের পরপরই জ্যামাইকায় তিনি প্রকাশ করেন ‘সারভাইভাল’ শিরোনামের একটি এ্যালবাম।
১৯৮০ সালে সফলতার চূড়ায় থাকা ওই সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন এবং ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে তিনি দু'টি শো করেন। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে জগিং করতে করতে পড়ে গেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার আগেই সনাক্ত হওয়া ক্যান্সার মস্তিষ্কসহ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মিয়ামির একটি হাসপাতালে ১৯৮১ সালের ১১ই মে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.