জন্মের ৩২৯ বছর, কলকাতার জন্ম ভুল করে হয়েছিল, জব চার্নক চেয়েছিলেন অন্য কিছু!


Odd বাংলা ডেস্ক: কলকাতা, আনন্দের নগরী। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতাকে বলা হয় ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। প্রায় ১,৪৮০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই শহরটি হুগলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাসে সমৃদ্ধ কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জব চার্নক নামের এক ইংরেজ সওদাগরের হাতে। উপমহাদেশে কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধি ও সুদৃঢ় করার জন্য সেদিন এই ইংরেজ হুগলীপাড়ের এক জলাভূমিতে যে বসতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, কালে কালে তা আজ এক সুবিশাল মেট্রোপলিটন সিটিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশত বছর আগে একজন ব্রিটিশ বেনিয়া কীভাবে এই উপমহাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ে এসে আস্তানা গাড়লেন, ধীরে ধীরে স্থাপন করলেন একটি শহর, যা পরবর্তী কালে হয়ে উঠলো উপমহাদেশের রাজধানী? আসুন পাঠক, আপনাদের জানাই এক দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, উচ্চাকাঙ্খী ও দূরদর্শী ইংরেজ রাজভৃত্যের জীবনের গল্প।

প্রাথমিক জীবন

জব চার্নকের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারের বাসিন্দা। ষোড়শ শতকে চার্নক বংশের একটি অংশ লন্ডনে এবং আরেকটি অংশ বেডফোর্ডশায়ারে বাস করা শুরু করে। জব চার্নকের বাবা রিচার্ড চার্নক লন্ডনের বাসিন্দা ছিলেন। তবে বেডফোর্ডশায়ারের পারিবারিক সম্পত্তিতেও তার মালিকানা ছিল। জব চার্নক ঠিক কত সালে জন্মেছিলেন তা নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। আসলে চার্নকের প্রাথমিক জীবন নিয়ে তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি ঐতিহাসিকরা। তার জন্মসাল আনুমানিক ১৬৩১। চার্নকের মায়ের মৃত্যু কখন হয় তা নিয়েও ঐতিহাসিকরা কিছু জানতে পারেননি। তবে যেহেতু রিচার্ড চার্নক তার উইলে নিজের স্ত্রী'র ব্যাপারে কিছু লিখে যাননি এবং উইলটি তিনি করেছিলেন ১৬৬৩ সালে, তাই ঐতিহাসিকরা ধরে নিয়েছেন চার্নকের মায়ের মৃত্যু ঘটেছিল ১৬৬৩ সালে বা তার আগে।
মেট্রো সিনেমা হল, এখন সেখানে চলছে নতুন শপিং মল মেট্রো সেন্ট্রাল (Image Source: Google)
 

ভারতবর্ষে আগমন

জব চার্নক ১৬৫৬ সালে প্রথম ভারতবর্ষে পৌঁছান। এরপর আর কখনো তিনি ইংল্যান্ডে ফেরত যাননি। প্রথমে কিছুদিন কাশিমবাজার ও হুগলীতে অবস্থান করেন। হুগলীতে কিছুকাল অবস্থান করার পর চার্নক পাটনায় চলে যান। ধীরে ধীরে তিনি ভারতবর্ষীয় আদবকেতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। থমাস ডেভিডকে লেখা হেনরি অ্যাল্ডওর্থের এক চিঠি থেকে জানা যায়, হুগলী থেকে পাটনা যাওয়ার পথে চার্নক ইংরেজদের মধ্যে সর্বপ্রথম চুল ছোট করে ভারতীয় পোষাক গ্রহণ করেন। সেকারণে তার জাতভাই ইংরেজরা হাসিঠাট্টা করলেও বাংলা আর বিহারের মানুষের কাছ থেকে তিনি প্রশংসাই পেয়েছিলেন। ভারত-জীবনের একদম শুরু থেকেই চার্নক স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি, অভ্যাসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি ঐ সময়ের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত ভাষা ফার্সিও শিখে নিয়েছিলেন তিনি।
পাটনায় ইংরেজদের কুঠি ছিল লালগঞ্জের পাশে সিংঘিয়ায়, গান্দাকি নদীর তীরে। ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৯ সালে জব চার্নক পাটনায় অবতরণ করেন এবং পরবর্তী বিশ বছর সেখানেই বাস করেন। চ্যাম্বারলেইন ছিলেন পাটনা কুঠির প্রথম প্রধান।
পাটনায় চার্নকের দায়িত্ব ছিল পাঁচ বছরের, ১৬৬৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে বাংলায় ইংরেজদের কুঠিসমূহের তৎকালীন নবনিযুক্ত প্রধান উইলিয়াম ব্লেকের অনুরোধক্রমে চার্নক ১৬৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস অবধি থেকে যাওয়ার মনস্থির করেন, কিন্তু সাথে জুড়ে দেন একটি শর্ত। তাকে পাটনা কুঠির প্রধান করতে হবে। অবশেষে তা-ই হয়, জব চার্নককে পাটনা কুঠির কুঠিয়ালের দায়িত্ব অর্পন করা হয়।
ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে হয়তো চার্নক পুনরায় মত পাল্টেছিলেন। কারণ ইংল্যান্ডে ফেরত না গিয়ে তিনি ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ষোল বছর একটানা পাটনা কুঠির 'কুঠির সাহেব'-এর দায়িত্ব পালন করেন। তবে এই স্থায়িত্বের পেছনে অন্য একটি কারণ থাকতে পারে। ঐ সময়, অর্থাৎ ১৬৬৩ সালের দিকে চার্নকের বাবা রিচার্ড চার্নক ইংল্যান্ডে মারা যান। একমাত্র ভাই, স্টিফেন তখন অজ্ঞাতবাস করছেন, তার খবর কেউ জানে না। তাই হয়তো স্বদেশে ফেরত যাবার কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাননি তিনি।
১৬৭১ সালে চার্নকের মাইনে বেড়ে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪০ পাউন্ডে। ১৬৭৮ সালে ফোর্ট সেইন্ট জর্জের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণের জন্য চার্নককে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেন।
১৬৭৯ সালের ১২ জুলাই, মাদ্রাজ কাউন্সিল চার্নককে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান হিসেবে স্যার এডওয়ার্ড লিটনটনের স্থলাভিষিক্ত করে। বাংলার রেশম বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল কাশিমবাজার। চার্নক এই পদ গ্রহণ করলেও তাৎক্ষণিকভাবে পাটনা ছেড়ে কাশিমবাজার চলে আসেননি। কারণ তিনি তখন পাটনা কুঠির উৎপাদিত পণ্য নৌকাবোঝাই করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
সে সময় হুগলী নদীতে জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল, প্রায়শই কোম্পানির মাল লুন্ঠন করে নিত তারা। তাই এসব ঝক্কি শেষ করার পরেই কাশিমবাজার কুঠির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার চিন্তা করেন তিনি। ঐ সময় ফোর্ট সেইন্ট জর্জের দুর্গপ্রতিনিধি ছিলেন স্যার স্ট্রেইন্সহ্যাম ম্যাস্টার। তিনি চার্নককে দেরি না করে কাশিমবাজার কুঠিতে তার লোকজন নিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব হাজিরা দিতে বলেন। এমনকি পাটনা থেকে আসতে চার্নকের দেরি দেখে তিনি তার পদোন্নতি বাতিলেরও হুমকি দেন। কিন্তু চার্নক তাতে কর্ণপাত করেননি। কারণ ততদিনে চার্নক বুঝে গিয়েছিলেন, কোম্পানির তার মতো লোকের প্রয়োজন, তাকে কখনো বিতাড়িত করবে না কর্তৃপক্ষ। আসলেই তা-ই। কারণ চার্নককে অনেকবারই স্থানীয় লোকজনের শক্ত বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এছাড়া এত বছরের স্থিতিকালে তিনি স্থানীয়দের মানসিকতা অনেকাংশে বুঝে গিয়েছিলেন। ফলে ক্রমশ তিনি একজন পোড়খাওয়া, অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ইংরেজ বেনিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
এদিকে প্রতিবছর ইংরেজদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেতে লাগল। ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলো, চার্নকের মতো অভিজ্ঞতালব্ধ কাউকেই তাদের দরকার ভারতবর্ষে ইংরেজ আধিপত্যের ভিত সুদৃঢ় করার জন্য। অবশেষে ১৬৮১ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির দায়িত্ব গ্রহণ করেন জব চার্নক।
যখন হাওডা ব্রিজ তৈরি হচ্ছিলো, তখনকার দৃশ্য (Image Source: Google)
 

ইঙ্গ-মুঘল যুদ্ধ

ব্রিটিশরা ভারতভূমিতে পদার্পণ করার পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে শুল্ক নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৬৮৬ সালের দিকে দু'পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লাগে এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষ চার্নকের অধীনে ঐ বছর একটি বাহিনী মোতায়েন করে। ক্যাপ্টেন আর্বাথন্যাটের সহায়তায় চার্নক হুগলী জেলার ফৌজদারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধনৈপুণ্য দেখে যারপরনাই বিস্মিত হন। তিনি কোম্পানির পণ্য বাজেয়াপ্ত করার পথ খুঁজছিলেন। তখন চার্নককে বাধ্য হয়েই শায়েস্তা খানের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।
ইংরেজ আর মুঘলদের এই দ্বন্দ্বের ফলে দিল্লির কোষাগারে রাজস্ব কমে আসছিল, কারণ এই অঞ্চল থেকে বাণিজ্যিক রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে আদেশ করেন, এই ঝামেলা শেষ করতে, মানে যুদ্ধ বন্ধ করতে।
অবশেষে ইংরেজ বাহিনীকে সসম্মানে যুদ্ধক্ষেত্র (হিজিলি) ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হয়, এমনকি উলুবেড়িয়ায় তাদেরকে ডক ও অস্ত্রাগার প্রতিষ্ঠারও অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু চার্নক উলুবেড়িয়া ত্যাগ করে তার সবগুলো জাহাজ নিয়ে পুনরায় সুতানটিতে ফেরত যাবার মনস্থ করেন।
কালিঘাট-ফলতা রেলওয়ে, আজ ইতিহাস তবু এখনও বেহালার মানুষ জেমস লং সরনীকে আজও রেল লাইন বলে (Image Source: Google)
 

সুতানটি: কলকাতা নগরীর ভ্রুণ

১৬৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চার্নক সুতানটি পৌঁছান। অবশ্য এ সময় তিনি সুতানটিতে একেবারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে পারেননি। কারণ ইংরেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে ছিল, হুগলী সংলগ্ন অঞ্চলের বদলে চট্টগ্রামে তাদের স্থায়ী আস্তানা গড়তে, সে উদ্দেশে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথকে পাঠানো হয় চার্নকবাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথ ছিলেন একজন 'উগ্রস্বভাবের, খামখেয়ালি, ক্ষীণবুদ্ধি ও অস্থিরচিত্ত'তরুণ সেনাপতি। তিনি সুতানটি এসেই সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রার আয়োজনের আদেশ করেন, এমনকি তিনি চার্নকের কোনো উপদেশ বা অনুরোধই কানে তোলেননি।
পুরনো হাওড়া স্টেশন (Image Source: Google)
 
১৬৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর দলটি বেলাশুর পৌঁছে এবং তা দখল করে নেয়। এরপর ক্যাপ্টেন চট্টগ্রামের দিকে পাল তুলে দেন। কিন্তু অবশেষে স্থানীয় রাজার শক্ত বিরোধিতার কারণে চট্টগ্রামে ইংরেজ কলোনি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে ১৬৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যর্থ-মনোরথ ক্যাপ্টেন হিথ পুনরায় সেইন্ট জর্জ দুর্গের উদ্দেশে রওনা দেন।
১৬৯০ সালের ২৩ এপ্রিল, গভর্নর ইব্রাহীমের খানকে লেখা এক চিঠিতে দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেব ইংরেজদের ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদানের কথা জানান। বার্ষিক ৩০০০ রুপির বিনিময়ে এই অনুমতি প্রদান করা হয়। এদিকে প্রায় পনের মাস সেইন্ট জর্জ দুর্গে অনিচ্ছাকৃত দিন যাপনের পর জব চার্নক পুনরায় তার দলবল দিয়ে সুতানটির পথে রওনা দেন। ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট, রোববার, ত্রিশজনের দলটি পুনরায় সুতানটিতে পদার্পণ করে।
'ক্যালকাটা রিভিউ'-তে একজন লেখক জব চার্নকের সুতানটিতে অবতরণকে চিত্রায়িত করেছেন এভাবে 
১৬৮০ সালের কোনো এক গরমের দিনে, হুগলী নদীর তীরবর্তী ক্ষুদ্র গ্রাম সুতানটিতে কয়েকটি নৌকা এসে থামল। তারমধ্যে একটি ছিল বিশাল বজরা যার মাস্তুলের আগায় ব্রিটিশ পতাকা উড়ছিল। বজরাটি ছিল ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সশস্ত্র লোকজনে ভর্তি। একজন জমকালো দেখতে লোক বজরার পাটাতনে স্থির দন্ডায়মান, যার মাথার ওপর টকটকে লাল কাপড়ের ছাতা। অর্ধ ফ্লেমিশ, অর্ধ স্প্যানিশ পোষাক পরিহিত ইংরেজ ভদ্রলোকের মাথার ওপর প্রশস্থ কানাওয়ালা বীবরের (beaver) চামড়ার টুপি, বাম পাশে দু'খানা পালক বিদ্যমান। নিচ থেকে খেয়াল করলে হয়তো তার লম্বা ধূসর রংয়ের চুল দেখা যেতে পারে। হলুদাভ বাদামি রংয়ের সাটিন কাপড়ের খাটো ডাবলেট (Doublet), উজ্জ্বল খাটো দেশীয় রেশমের তৈরি আলখাল্লার সাথে গলায় ঝোলানো রাফ এবং ফিতা লাগানো ঝুলন্ত কলার। সেই সুদর্শন পুরুষের কোমরে মহিষের চামড়া দিয়ে তৈরি মোটা বেল্ট, বৃহৎ স্বর্ণনির্মিত বগলস। বেল্টে ঝোলানো হালকা সরু তরোয়াল এবং সামনের দিকে অলঙ্কৃত জোড়া পিস্তল। তার ঘন ভ্রু, কাঁচাপাকা গোঁফ, ধূর্ত চাহনি, গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরের ওঠানামা তাকে দিয়েছে এক অভূতপূর্ব কাঠিন্য। তীরে বহন করে নামানোর পর জনতা তাকে অভিবাদন জানালো।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.