বাংলার প্রকৃতিকে মাতৃ রূপে দেখেছিলেন যিনি, জন্মদিনে বিভূতিভূষণ
Odd বাংলা ডেস্ক: মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান- এই সত্য প্রতিফলিত হয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন রচনায়। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে তাঁর রচনায়। বিভূতিভূষণ প্রকৃতির অনুপুংখ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন মানবের গভীর জীবনদৃষ্টিকেও। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচিত্র ও সমকালের আর্থ সামাজিক বাস্তবতাও সমানভাবে উঠে এসেছে তাঁর রচনায়। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
বিভূতিভূষণের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর (১৩০০ বঙ্গাব্দ, ২৯ ভাদ্র) বুধবার, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাচরাপাড়া হালিশহরের মধ্যবর্তী মুরারিপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। পিতা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় এবং মা মৃণালিনী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ব্যারাকপুরের বনগ্রামে। তাঁর পিতার পেশা ছিল কথকতা ও পৌরোহিত্যের। তাই তাঁদের সংসারিক অবস্থাও মোটেই সচ্ছল ছিল না। তিনি বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর কোলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯১৮ সালে ডিষ্টিংশনসহ বিএ পাস করেন। তারপর আরো উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি এমএ এবং একই সঙ্গে ‘ল’ পড়ার জন্যও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য আর পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি তাঁর। ফলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে তিনি চাকরিতে যোগ দেন।
২৩ বছর বয়সে তিনি শ্রীমতী গৌরীদেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু এ বিয়ের অল্পকাল পরেই গৌরীদেবীর অকালমৃত্যু ঘটে। এর ২৩ বছর পর ১৯৪১ সালে তিনি রমাদেবীকে (ওরফে কল্যাণী দেবী) বিয়ে করেন। এই বিয়ে তাঁর জীবনে বিশেষ করে, তার সাহিত্য জীবনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল।
বিভূতিভূষণ সমগ্র কর্মজীবনে মূলত স্কুল শিক্ষকতার কাজে জড়িত ছিলেন। প্রথমে তিনি হুগলি জাঙ্গিপাড়া গ্রামের স্কুলে, পরে সোনারপুর-হরিণাভি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কোলকাতায় খেলাৎচন্দ্র মোমোরিয়াল স্কুলে দীর্ঘকাল এবং জীবনের শেষপর্বে স্বগ্রাম ব্যারাকপুরের নিকটবর্তী গোপালনগর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। হরিণাভি স্কুলে থেকে খেলাৎচন্দ্র মোমোরিয়ালে যোগদানের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কেশোরাম পোদ্দারের তরঙ্গিনী সভায় প্রচারক, খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে গৃহশিক্ষক ও প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং ভাগলপুরের খেলাৎ ঘোষ এস্টেটের নায়েব তহশিলদার প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। সোনারপুর-হরিণাভি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ে ‘উপেক্ষিতা’ নামক গল্প লেখেন ১৯২২ সালে; মাসিক প্রবাসীর ১৩২৮ সনের মাঘ সংখ্যায় তা ছাপা হয়- এটিই তাঁর প্রথম রচনা।
বাংলার পল্লীর অপরূপ সৌন্দর্য বিভূতিভূষণকে শৈশব থেকেই মুগ্ধ করত। পরবর্তীকালে এই প্রকৃতি পাঠের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা নানাভাবে তার রচনাকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করেছে। বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে 'বিচিত্রা' পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। বাংলার শ্বাশ্বত গ্রাম - গ্রামের প্রকৃতি ও মানুষ এই উপন্যাসের কথাবস্তু।
‘পথের পাঁচালী’ মুখ্যত শিশু অপুর বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনি। যে পথ দিয়ে জীবনে সে অগ্রসর হয়েছে, যেসব মানুষের সংস্পর্শে সে এসেছে, তা সেই কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পটভূমিটি সুবিস্তৃত। পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উপাখ্যান যদিও দূর ইতিহাসের অঙ্গীভূত, কৌলীন্য প্রথার অমানবিক যন্ত্রে পিষ্ট ইন্দির ঠাকরুণের জীবনের ইতিহাস অত সুদূরের নয়। ইন্দির ঠাকরুণের প্রতি সর্বজয়ার আচরণ সবসময়ে মানবিক নয়। যে-মা দূর্গা ও অপুর জীবনে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত, পিসির প্রতি তার রূঢ় ব্যবহার তাদের জীবনের প্রাথমিক অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। উপন্যাসের পরবর্তী অংশ অপু-দূর্গা ও অপুর-দুর্গার শৈশবকাহিনি। শৈশবের সে কাহিনি অভিনবত্বে অসাধারণ নয়, কিন্তু মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তারা দুজনেই গ্রাম্য প্রকৃতিকে ভালোবাসে, রেলপথ তাদের কাছে এক রহস্যজগতের বার্তা পৌঁছে দেয়। নতুন নতুন অভিযানে দুর্গা হয় অপুর পথপ্রদর্শক, তবে অপুর মধ্যে অনুভূতির যে প্রখরতা এবং ভাবুকতার যে দোলা লক্ষ্য করা যায়, দূর্গার মধ্যে আমরা তা দেখি না। তবু চরিত্র হিসেবে এরা কেউই আদর্শায়িত নয়, প্রলুব্ধ দুর্গা চুরি করতেও কুণ্ঠিত হয় না- সে চুরির চিহ্ন মুছে দিতে অপু পরে তৎপর হয়, ততদিনে অবশ্য দুর্গা আর নেই। দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনে বড়োরকম আঘাত হানে, তার অভ্যস্ততায় ছেদ টানে , কিন্তু তা অপুর স্বাধীন বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার পথও উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর কাহিনি একান্তই অপুর। জীবন ও প্রকৃতিকে অপু অবলোকন করেছে অপরিসীম বিস্ময় ও গভীর মুগ্ধতার সঙ্গে । অপুর দুই পা বাস্তব পৃথিবীতে প্রোথিত, কিন্তু তার দু-চোখে রোমান্সের কাঁজল। স্বভাবসিদ্ধ কল্পনাপ্রবণতা ও তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যানুভূতির গুণে সে মানুষের মধ্যে যে বিজন মহত্ত্ব অনুভব করে এবং প্রকৃতির মধ্যে যে ঐন্দ্রজালিক মোহনীয়তার সন্ধান পায়, অন্যের কাছে তা সহজে ধরা দেয় না। আমরা যে শ্রীহীন গ্রামকে জানি, যে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে চিনি, যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, এখানে তার সবই অন্যরকম শ্রী, অন্যরকম শক্তি, অন্যরকম অবয়ব নিয়ে ধরা পড়ে। বস্তুর রূপকে ভেদ করে স্বরূপের উপলব্ধি অপুর দৃষ্টিভঙ্গির বড়কথা। এই দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত বলেই ঔপন্যাসিকের আত্মস্মৃতিমূলক এই উপন্যাস এমন মোহনীয় হয়ে উঠেছে।
সাহিত্য জীবনে বিভূতিভূষণ গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও দিনলিপি ইত্যাদি বিবিধ শ্রেণীর রচনা মিলিয়ে অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। বিভূতিভূষণের সমগ্র সাহিত্যে নানাভাবে তার ব্যক্তিজীবনের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দুখন্ডে লিখিত উপন্যাস পথের পাঁচালী ও অপরাজিতা ছাড়াও সাহিত্যজীবনে বিভূতিভূষণের আর একখানি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি আরণ্যক। এই উপন্যাসটির পরিকল্পনা বাংলা উপন্যাস সাহিত্য এক নতুন সংযোজন। বিভূতিভূষণের কাহিনীবয়নের পরিচিত গতির কিঞ্চিৎ বাইরে অবস্থান আরণ্যক-এর গল্পপ্রক্ষেপণ ও পরিবেশনশৈলী। অরণ্যরহস্য এবং অরণ্যবিনাশের কাহিনীর অন্তরালে বিপন্ন-অপরাধী শিল্পী যেন আঁকছেন সভ্যতার আগ্রাসনের ছবি। উপন্যাসে বিবৃত প্রকৃতিচরাচরের শান্ত-স্নিগ্ধতা বিপুল বিশ্বব্যাপী নাস্তির বিপরীতে মহাকালাশ্রয়ী চৈতন্যে দীক্ষার প্রান্তরে হাতছানি দিয়ে ডাকে; যে আহ্বান পার্থিব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চিন্তালোকের অন্ধকার থেকে অনেক দূরে এগিয়ে যেতে শক্তি যোগায়। ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। তাই ফিরে দেখা দরকার তাঁর সাহিত্য জীবন।
লোকবিশ্বাস-ধর্মাচার-ভগবানপ্রীতি-জীবনবোধ ইত্যাকার যাবতীয় প্রসঙ্গ। লেখক তাঁর অভিমত প্রকাশ করছেন এভাবে : "এ অঞ্চলের বনসভ্যতার প্রতীক ওই প্রাচীন বৃদ্ধা"। পৃথিবীতে এক দিকে কোনো কোনো জাতি যখন ভাষা-সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্থাপত্যকলা, নগরপত্তন, বাণিজ্যবিস্তার, যোগাযোগ ও প্রচারমাধ্যম এবং সৌন্দর্য বিকাশে ক্রমাগত অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে, তখন কী কারণে কোনো কোনো আদিম জাতি তাদের আদিমতা থেকে একধাপও অগ্রসর হতে পারলো না; পেশা-জীবিকা আর জীবনধারণায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল হাজার হাজার বছর আগের সেই জায়গাটিতেই- তা সত্যিই অতি বিস্ময়ের! কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ সেই বিস্ময়ের দুয়ারে হতভম্বের মতো স্থির থাকেন যেন কিছুকাল; আর সংগ্রহ করেন আরণ্যক উপন্যাসের উপাদান।
বাংলা সন অনুসারে প্রকাশকালসহ তাঁর রচিত কয়েকটি প্রধান উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ পথের পাঁচালী (১৩৩৬), মেঘাল্লার (১৩৩৮), অপরাজিতা (১৩৩৮), মৌরীফুল (১৩৩৯), যাত্রাবদল (১৩৪১), দৃষ্টি প্রদীপ (১৩৪২), কিন্নরদল (১৩৪৫), আরণ্যক (১৩৪৫), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৩৪৭), অনুবর্তন (১৩৪৯), দেবযান (১৩৫১), তালনবমী (১৩৫১), কেদাররাজা (১৩৫২), মুখোশ ও মুখশ্রী (১৩৪৫), ইছামতি (১৩৫৬) ও চাঁদের পাহাড় (১৩৫৭) ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণের বিভিন্ন গ্রন্থ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত প্রকাশ করেছে। বিদেশীভাষার মধ্যে ইংরেজি ও ফরাসিতেও পথের পাঁচালী -র অনুবাদ হয়েছে। ইছামতি উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ কে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়।
Post a Comment