ক্যাপ্টেন মারভেলই কিন্তু আসলে শ্যাজাম, কীভাবে এসেছে সুপারহিরোর এই পরিবর্তন জানেন?
Odd বাংলা ডেস্ক: বিংশ শতকের গোড়ার দিকে সুপারম্যানের বিরাট সফলতা অন্যান্য কমিকস প্রকাশনীগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করে সুপারম্যানের মত চরিত্র সৃষ্টি করতে। তাই একের পর এক আসতে থাকে স্কাইম্যান, ক্যাপ্টেন ফ্রিডম, দ্য ফ্লেইম, স্টারডাস্ট দ্য সুপার উইজার্ড অথবা গ্যারি কনকর্ড দ্য আল্ট্রাম্যানের মত সুপারহিরো। কিন্তু তাদের কেউই ক্যাপ্টেন মারভেলের মত সফল হয়নি। ১৯৪০ সালে উইজ কমিকসের দ্বিতীয় ইস্যুতে এমন একটি চরিত্রের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় যা জনপ্রিয়তার দিক থেকে সুপারম্যানকে হারাতে সক্ষম হয়। সে চরিত্রটি সৃষ্টি করেন লেখক বিল পার্কার এবং আর্টিস্ট সি.সি. বেক। প্রথমে তারা চরিত্রটির নাম দিতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন থান্ডার। কিন্তু সে নামটি আরেকটি প্রকাশনী তখন ব্যবহার করছিল। তাই তারা তাদের চরিত্রটির নাম রাখেন ক্যাপ্টেন মারভেল। ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকসে আবির্ভাব থেকে পরবর্তী গল্পগুলো ভরপুর ছিল জাদু এবং ফ্যান্টাসির মিশ্রণে।
ডিসি এবং মার্ভেল কমিক্সের চরিত্র নিয়ে লড়াই তখন তুঙ্গে, Image Source: Google |
ক্যাপ্টেন মারভেল আদতে ১২ বছর বয়সের বিলি ব্যাটসন। অল্প বয়সেই বাবা-মাকে হারানো বিলি তার অদ্ভুত সব ক্ষমতা পায় শ্যাজাম নামক এক বুড়ো জাদুকরের কাছ থেকে। বিলি যখনই চিৎকার করে জাদুকরের নাম বলত, তখনই তার উপর বজ্রপাত হত এবং সে ক্যাপ্টেন মারভেলে পরিণত হত। তারপর সে শুরু করে দুষ্ট লোকদের হারিয়ে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষার মিশন। এখানে ক্যাপ্টেন মারভেল যেন তার পাঠকদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। কারণ তখনকার কমিকস পড়ুয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু কিশোর। তাদের মত একই বয়সের বিলি ব্যাটসন জাদুর একটি শব্দ বলে সুপারহিরোতে পরিণত হয়, এই বিষয়টি শ্যাজামের জনপ্রিয়তায় অনেক বড় প্রভাব ফেলে। ততটা কখনোই ফেলতে পারেনি ভিন্ন গ্রহে জন্মানো সুপারম্যান, যে একজন সাংবাদিকের ছদ্মবেশে থাকে। তাইতো উইজ কমিকসের সেই ইস্যুটির ৫ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়। ক্যাপ্টেন মারভেলের বাদবাকি চরিত্রগুলোও ছিল অনেক মজার। তার প্রধান শত্রু ডক্টর শিভানা, যে টাক মাথার এক পাগল বিজ্ঞানী। আরো ছিল মিস্টার মাইন্ড, যে আদতে একটি শুঁয়োপোকা এবং কথা বলতে পারা বাঘ টকি টউনি। এদিকে ক্রাইম ফাইটে ক্যাপ্টেন মারভেল কিছু সঙ্গী খুঁজে পায়, যেটাকে বলা হতো মারভেল ফ্যামিলি। সে ফ্যামিলিতে একে একে যোগ দেয় মেরি মারভেল, আংকেল মারভেল, হপি দ্য মারভেল বানি এবং ক্যাপ্টেন মারভেল জুনিয়র, যে এলভিস প্রিসলির প্রিয় একটি চরিত্র ছিল। ক্যাপ্টেন মারভেল সেই বছরেই সুপারম্যানকে ছাড়িয়ে যায় কমিকস বিক্রির দিক দিয়ে। জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, প্রথম কমিকস বই সুপারহিরো হিসেবে নাম লেখিয়ে ফেলে সিনেমার পর্দায়। দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ ক্যাপ্টেন মারভেল নামক সিনেমাটি মুক্তি পায় রিপাবলিক পিকচারস থেকে। তবে তারা আগে থেকেই ন্যাশনাল কমিকস (যার একটি অংশ ছিল ডিটেকটিভ কমিকস) এর সাথে কাজ করছিল সুপারম্যানের একটি সিনেমা নির্মাণ করতে।
পুরানো শ্যাজাম সিনেমা, Video Source: Youtube
একটা সময় এটাও বলা হয়েছিল যে সুপারম্যানকে কপি করেই আসলে ক্যাপ্টেন মারভেল বানানো হয়েছে, Image Source: Google |
ডিসির দাবি ছিল ক্যাপ্টেন মারভেলের ক্ষমতা এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো সুপারম্যানের সাথে খুব বেশিই মিলে যাচ্ছিলো, যেটা কপিরাইটের আইনের লঙ্ঘন। অপরদিকে অফসেটের দাবি, যদিও এই দুই সুপারহিরোর মধ্যে মিল আছে, তারমানে এই না যে এটা আইন লঙ্ঘন করেছে। এরকম মিল আরো অনেক কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যেই আছে, যেমন টারজান বা পাপায়। ১৯৬৭ সালে মারভেল সুপার-হিরোজের ১২ তম ইস্যুতে ক্যাপ্টেন মারভেলের প্রথম আবির্ভাবের পর মায়রন ফাঁস ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ট্রেডমার্ক ব্যবহার করায়। মারভেল কমিকসের জবাব ছিল, তাদের কাছে 'মারভেল' শব্দটি ব্যবহার করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এখানে যদি কেউ আইন ভঙ্গ করে সেটা করেছে এম. এফ. এন্টারপ্রাইজ। এই মামলার খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং এম. এফ. এন্টারপ্রাইজ সাড়ে চার হাজার ডলারের বিনিময়ে ক্যাপ্টেন মারভেলের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। মারভেল কমিকসের ক্যাপ্টেন মারভেলও যথেষ্ট শক্তিশালী চরিত্র ছিল। পরের বছরই সে তার নিজস্ব সিরিজ পায়। কিন্তু চরিত্রটি অতটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলো না। তা নিয়ে কমিকস হিস্টোরিয়ান ডন মার্কেস্টাইন বলেন, "মারভেল আসলে জানতো না তারা এই চরিত্রটিকে নিয়ে কী করবে! তারপরেও তারা প্রতিনিয়ত তার কমিকস প্রকাশ করেই যাচ্ছিল।"
বেশ কয়েকবার ঘষামাজা করে মার-ভেলকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। তাকে নতুন স্যুট দেয়া হয়, বেশ কিছু ক্ষমতাও দেয়া হয়। কিন্তু সফলতা আসেনি। তাই তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। ১৯৮২ সালে জ্যাক কারবির আঁকা দ্য ডেথ অফ ক্যাপ্টেন মারভেল গ্রাফিক্স নভেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ক্যাপ্টেন মারভেল। এখন যদি মারভেল তাদের এই ক্যাপ্টেন মারভেল ট্রেডমার্কটি ধরে রাখতে চায়, তাহলে দুইবছরে অন্তত একবার তাদেরকে ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকস প্রকাশ করতে হবে। তাই তারা পুরনো মার-ভেলের গল্পগুলোই নতুনভাবে লাইফ অফ ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকসে প্রকাশ করতে থাকে।
কমিক আঁকতে গিয়েও সুপারম্যানকে কপি করে ফেলে ক্যাপ্টেন মার্ভেল |
মার-ভেলের মৃত্যুর একমাস পরেই মারভেল নিয়ে আসে দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন মারভেল মনিকা রেম্বোউকে, যে ছিল নিউ অরল্যান্সের একজন পুলিশ লেফটেন্যান্ট। এরপর তৃতীয় ক্যাপ্টেন মারভেল হিসেবে আসে জেনিস-ভেল, যে মার-ভেলের ছেলে। তারপর আসে চতুর্থ ক্যাপ্টেন মারভেল পাইলা-ভেল, পঞ্চম ক্যাপ্টেন মারভেল Khn'nr, এবং ষষ্ঠ ক্যাপ্টেন মারভেল নোহ-ভার। এই ক্যাপ্টেন মারভেলদের মধ্যে মনিকা রেম্বোউ এবং জেনিস-ভেল ভালই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হচ্ছিলো না মারভেল। কারণ তারা তখনো এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না যে এই ট্রেডমার্কটির জন্য সবচাইতে উপযুক্ত। অপরদিকে সে সময়টায় অল্প কিছু কমিকস পড়ুয়া বাদে বেশিরভাগ মানুষই ভুলে যেতে বসেছিল একসময়ের জনপ্রিয় ফসেট কমিকসের ক্যাপ্টেন মারভেলের কথা। কিন্তু ডিসি সেটা ভুলেনি। ১৯৭০ এর দিকে ডিসির কমিকস বিক্রি কিছুটা কমে যায় মারভেলের জনপ্রিয়তার কারণে। তা মারভেলের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ঠিক করে তারা ফিরিয়ে আনবে ১২ বছর বয়সী সুপারহিরো ক্যাপ্টেন মারভেলকে। এদিকে তখন ফসেট কমিকস ১৯৬০ এর দিকে ফিরে এসেছিল ডেনিস দ্য মেনাকের পাবলিশার হিসেবে। কিন্তু সুপারহিরো কমিকস প্রকাশে তাদের হাত বাঁধা ছিল। তখন ডিসি তাদের প্রস্তাব দেয় ক্যাপ্টেন মারভেলের লাইসেন্স তাদের দিয়ে দিতে। ফসেট কমিকস সেই প্রস্তাবে রাজি হয় এবং ক্যাপ্টেন মারভেল আর তার সবগুলো চরিত্র ব্যবহারের সবরকমের অনুমতি ডিসিকে দিয়ে দেয়। এখন বিশ্বের সবচাইতে বড় দুটি কমিকস প্রকাশনীর কাছেই ক্যাপ্টেন মারভেল নামের সুপারহিরো আছে! কিন্তু ডিসি চাইলেও তাদের ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকসকে 'ক্যাপ্টেন মারভেল' নামে প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ সে নামের রাইট তখন মারভেলের কাছে। তাই তারা ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকস বের করে 'শ্যাজাম' নামে, যে একই নামে একটি টিভি সিরিজও বের হয়। তবে ১৯৭৩ সালে ক্যাপ্টেন মারভেলকে নিয়ে বের করা প্রথম কমিকস সিরিজে ডিসি একটি অদ্ভুত কাজ করে। তারা কমিকসটির নাম দেয়, শ্যাজাম: দ্য অরিজিনাল ক্যাপ্টেন মারভেল । কিন্তু মাত্র ১৫টি ইস্যুর পর যখন মারভেল তাদেরকে সতর্ক করে চিঠি পাঠায়, তারা কমিকসটির নাম পরিবর্তন করে রাখে শ্যাজাম: দ্য ওয়ার্ল্ডস মাইটিয়েস্ট মর্টাল। এরপর থেকে ডিসি নিয়মিতভাবেই শ্যাজাম নামেই তাদের কমিকসগুলো প্রকাশ করে।
কপিরাইট নিয়মে ফাঁকি দিতেই রাতরাতি ক্যাপ্টেন মার্ভেলকে শ্যাজাম বানিয়ে দেওয়া হয় |
যেমন ১৯৮৭ তে শ্যাজাম! দ্য নিউ বিগিনিং, ১৯৯১ তে দ্য পাওয়ার অফ শ্যাজাম! ২০০৬ এ দ্য ট্রায়ালস অফ শ্যাজাম! এবং ২০০৭ এ শ্যাজাম! দ্য মনস্টার সোসাইটি অভ ইভিল। প্রতিটি সিরিজ যদিও কিছু অল্পসময়ের জন্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল, কিন্তু বেশিদিন তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। এদিকে বইয়ের মলাটে শ্যাজাম নামটির কারণে অনেকে ধরেই নিয়েছিল, চরিত্রটির নামই শ্যাজাম। ২০১১ সালে ডিসি কমিকস তাদের পুরো কমিকস জগতটিকেই রিবুট করে, যেটা পরিচিত নিউ ৫২ নামে। তখন সব চরিত্র পাচ্ছিল তাদের নতুন ইস্যু এবং তাদের সাজিয়েও তোলা হয়েছিল নতুনভাবে। তখন ডিসি সিদ্ধান্ত নিলো ,যেহেতু তাকে সবাই শ্যাজাম হিসেবেই চিনে সেটাই তার আসল নাম হোক। এ বিষয়ে জেফ জোন্স বলেন, "শ্যাজাম নামটি চরিত্রটির সাথে বেশ ভালোভাবেই যায়, যদিও অনেক মানুষ জানে এটাই তার আসল নাম।" তাই ২০১২ সালে জেফ জোন্স জাস্টিস লীগের ৭ নং ইস্যুতে অফিশিয়ালি প্রথম ক্যাপ্টেন মারভেলকে শ্যাজাম হিসেবে প্রকাশ করেন। প্রায় ৮০ বছর ধরে সুপারহিরোদের জয়যাত্রার শুরু থেকে এই ক্যাপ্টেন মারভেল নামটি চলে আসছে। যদিও সুপারম্যানের সাথে মিল থাকায় এত বছর ধরে লড়তে হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও শ্যাজাম সুপারম্যানের উড়তে পারায় এবং লেক্স লুথরের মত শত্রু সৃষ্টিতেও অনুপ্রেরণা ছিল। অপরদিকে মারভেলের ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকস এবং অ্যানিমেশনে সফলতার পর রুপালী পর্দাতেও সাড়া জাগাতে পেরেছে। তো এভাবেই একটি কপিরাইট লঙ্ঘনের মামলা এবং আদালতে ১২ বছর ধরে চলা যুদ্ধ ডিসি কমিকসে শ্যাজাম এবং মারভেল কমিকসে ক্যাপ্টেন মারভেলের জন্ম দিলো।
Post a Comment