আজ ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েটের তিরোধান দিবস, তিনি একজন বাঙালি


Odd বাংলা ডেস্ক: কামিনী যে সময়ে মানুষ হয়েছেন তখন মেয়েদের পড়াশোনা শেখার প্রচলন ছিল না। এটি একটি নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য হত। সমাজপতিদের ধারণা ছিল, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলেই অন্যের সঙ্গে পত্রালাপ করবে। কামিনীর জননী নিজের চেষ্টায় একটু লেখাপড়া করেছিলেন; তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। রান্নাঘরে মাটির দেয়ালে শলাকার সাহায্যে অক্ষর লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। লেখা হয়ে গেলে গোবর জল লেপে সেগুলি পরিষ্কার করে রাখতেন যাতে বয়স্কদের চোখে না পড়ে। শোনা যায় কামিনীর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে সন্তানের লালন পালন সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে কামিনীর বাবা তার স্ত্রীকে একটি পত্র লিখেছিলেন। যে কোন কারণেই হোক সে পত্র যথাস্থানে না পৌঁছে গ্রামের অন্য এক ব্যক্তির হাতে গিয়ে পড়ে। তিনি চিঠিটি পড়ে কামিনীর পিতামহকে পৌঁছে দেন। এটি জানাজানি হলে এই ‘গর্হিত’ কর্মের জন্য গ্রামে শোরগোল পড়ে যায়।


কামিনী চার বছর বয়সে লেখাপড়া শুরু করেন। মা যখন রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন শিশু কামিনী তার নিজের হাতে তৈরি মাটির দোয়াতে কালি ভরে খাকের কলম দিয়ে তালপাতার উপর লিখতে বসতেন। স্কুলে আপার প্রাইমারী পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পিতার কাছে গণিত শাস্ত্র শিখে তিনি এ বিষয়ে এতদূর পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে গণিত শিক্ষক শ্যামাচরণ বসু তাকে লীলাবতী আখ্যা দিয়েছিলেন। চোদ্দ বছর বয়সে কামিনী মাইনর পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পিতা চণ্ডীচরণ ছিলেন জলপাইগুড়ির মুন্সেফ। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে বিভিন্ন বিষয়ের বহু গ্রন্থ ছিল। সময় পেলেই কামিনী পিতার গ্রন্থাগারে গিয়ে পড়াশোনা করতেন। এ সময়ে প্রায় দেড় বছর কাল তিনি পিতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ছিল ইংরাজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি। Morning and evening meditations নামক গ্রন্থ থেকেও রোজ একটি করে কবিতা মুখস্থ করতে হত। পিতা কামিনীকে বলতেন, সর্বদাই মনে রাখবে Your life has a mission. এটা সম্ভবতঃ কন্যার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।


ষোল বছর বয়সে কামিনী প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল বাংলা। এর দু’বছর পর এফ. এ. পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং পরে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হবার সম্মান লাভ করেন তিনি। চাকরির সুযোগ এলে পিতার আপত্তিতে সেটা হয়ে ওঠে নি। পিতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন – “অধিকাংশ ছেলে আজকাল চাকরী পাবার জন্য পড়াশোনা করেন। জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য নয়। কন্যাকে আমি কখনই চাকরী করিতে দিব না।”


কামিনী সেন তার পরিবারে ব্রাহ্মধর্মের আদর্শেই মানুষ হয়েছেন। তার ভগিনী ড: যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে অন্য অনেকের পরামর্শে কন্যাকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য পিতা কামিনীকে চাকরি করতে বাধা দেন নি এবং ১৮৮৬ সালে কামিনী বেথুন কলেজে শিক্ষয়িত্রীর পদে নিযুক্ত হন। তার রচনা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – “ ...... ‘মেদিনী’ নামক মেদিনীপুরে একখানি সাপ্তাহিক কাগজ ছিল। পিতা তাহার জন্য আমাকে কবিতা দিতে অনুরোধ করেন। তদনুসারে ‘প্রার্থনা’ ও ‘উদাসিনী’ শীর্ষক দুইটি কবিতা দিয়াছিলাম। ...... ‘আলোচনা’ নামক মাসিক পত্রিকায় প্রসন্নময়ী দেবীর লিখিত ‘কেন মালা গাঁথি’ – ‘কুমারী চিন্তা’ নামক কবিতা পড়িয়া আসিয়া পরদিন ‘সঞ্জীবনী-মালা’ লিখি। প্রসন্নময়ী প্রবীণা বিবাহিতা - কুমারীর চিন্তা লিখিলেন, আমি কুমারী হইয়া প্রবীণার মত তাহার উত্তর দিলাম। এ এক তামাসা!”


সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায় বিয়ের অনেক আগেই কামিনী রায়ের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। তারই আগ্রহে ১৮৯৪ সালে কামিনী সেনকে তিনি পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। কামিনী সেন রূপান্তরিত হন কামিনী রায় নামে, যে নামে তিনি পরবর্তী কালে কবি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বিয়ের অব্যবহিত পরে কামিনী রায় তেমন ভাবে কবিতা লেখেন নি, শুধু ‘গুঞ্জন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময়ে তিনি গৃহকর্ম ও সন্তান পালনই তার প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। জনৈক বন্ধু তাকে কবিতা না লেখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন –“এগুলিই আমার জীবন্ত কবিতা।” তিনি সংসারে মন দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার অদৃষ্টে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। ১৯০০ সালে তার এক সন্তানের মৃত্যু হয়। ১৯০৮-এ ঘোড়ার গাড়ি উলটে গিয়ে তার স্বামী পরলোক গমন করেন। কন্যা লীলা ও পুত্র অশোকের মৃত্যু ১৯২০ সালে। এত শোকের আঘাতে কবি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। পুত্র অশোকের মৃত্যুর পর রচিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘অশোক সঙ্গীত’। শোকের আঘাত কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি আবার কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। তার গ্রন্থ প্রকাশনার সময় নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা যায়। তার রচিত কাব্যগ্রন্থ – ‘আলো ও ছায়া’ (১৮৮৯); ‘নির্ম্মাল্য’ (১৮৯০); ‘পৌরাণিকী’ (১৮৯১-৯২ সালে রচিত, ১৮৯৯-এ প্রথম প্রকাশ); ‘অম্বা’ (নাট্যকাব্য, ১৮৯১-এ রচিত ও ১৯১৫ তে প্রকাশিত); ‘গুঞ্জন’ (শিশু কবিতা পুস্তক, ১৯০৫); ‘ধর্ম্মপুত্র’ (অনুবাদ গল্প, ১৯০৭); ‘শ্রাদ্ধিকী’ (১৯১৩); ‘অশোক স্মৃতি’ (স্মৃতিকথা, ১৯১৩); ‘মাল্য ও নির্ম্মাল্য’ (১৯১৩); ‘অশোক সঙ্গীত’ (১৯১৪); ‘সিতিমা’ (গদ্য নাটিকা, ১৯১৬); ‘ঠাকুরমার চিঠি’ (১৯২৩); ‘দীপ ও ধূপ’ (১৯২৯); ‘জীবন পথে’ (১৯৩০) ও ড: যামিনী রায়ের জীবনী (জীবনী গ্রন্থ)। কবিতা ছাড়া বিভিন্ন ধরণের লেখা তিনি লিখলেও মূলতঃ কবি হিসাবেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তার কবিতা ‘নব্যভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘বিচিত্রা’, ‘বঙ্গলক্ষী’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। তার অনেক লেখা রচনা কালের বহু পরে প্রকাশিত হয়েছে। ‘অম্বা’ প্রকাশিত হয়েছে রচনা করার চব্বিশ বছর পরে। একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন – “আমার মনে হয় আমি কিছু অকালপক্ক ছিলাম। কতকগুলি বিষয় আমি রবীন্দ্রনাথের পূর্ব্বেই লিখিয়াছি, কিন্তু তিনি যখন লিখিয়াছেন, অনেক সুন্দর করিয়া লিখিয়াছেন। যাহা শীঘ্র বাড়ে, তাহা শীঘ্রই নষ্ট হয়, প্রকৃতির মধ্যে ইহা সর্ব্বদাই দেখি। অশ্বত্থ বটাদি বনস্পতি ধীরে বাড়ে, যত দীর্ঘায়ু হয়, লাউ, কুমড়া, শশা, অন্য শাকাদি সে রকম হয় না। দু’দিনে বাড়ে, দু’দিনে মরে। যে সব ছেলে Precocious তাহাদের মধ্যে কেহই বড় হইয়া বড়লোক হয় না। আমার মধ্যে একটা precocity ছিল, কিন্তু বয়সের সঙ্গে বৃদ্ধি দেখা গেল না। অবশ্য সারা জীবন কতকগুলি প্রতিকূল ঘটানার মধ্য দিয়াই আসিতে হইয়াছে। সাহিত্যের সাধনা ও অনুশীলনের সুযোগ ঘটে নাই। মনের জড়তাও ছিল।”


কামিনী রায়ের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’। এটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ সালে এবং অষ্টম সংস্করণ বের হয় ১৯২৫-এ। গ্রন্থটি যে পাঠক সমাজে আদৃত হয়েছিল, এটা তারই প্রমাণ। কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রন্থটি পাঠ করে প্রশংসার সঙ্গে লিখেছিলেন – “এই কবিতাগুলি আমাকে বড়ই সুন্দর লাগিয়াছে; স্থানে স্থানে এমন মধুর ও গভীর ভাবে পূর্ণ যে, পড়িতে পড়িতে হৃদয় মুগ্ধ হইয়া যায়। ফলতঃ বাঙ্গালা ভাষায় আমি এইরূপ কবিতা অতি অল্পই পাঠ করিয়াছি। ...... বস্তুতঃ কবিতাগুলির ভাবের গভীরতা, ভাষার সরলতা, রুচির নির্মলতা, এবং সর্বত্র হৃদয়গ্রাহিতাগুণে আমি নিরতিশয় মোহিত হইয়াছি। পড়িতে পড়িতে গ্রন্থকারকে কতই সাধুবাদ প্রদান করিয়াছি। আর বলিতে কি স্থলবিশেষে হিংসারও উদ্রেক হইয়াছে।” এক সময়ে কবির ‘সুখ’ কবিতাটি লোকের মুখে মুখে ফিরত। কবিতার কয়েক পংক্তি –


“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
Blogger দ্বারা পরিচালিত.