মিতিন মাসি, বাংলার ওয়ান্ডার ওম্যান এবার কোয়েল



Odd বাংলা ডেস্ক: সুপারম্যানকে টেক্কা দিতে যদি ওয়ান্ডার ওম্যান থাকতে পারে তবে ব্যোমকেশ ও ফেলুদাকেও টেক্কা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। নারী শক্তিকেও গোয়েন্দা দফতরে তুলে ধরা দরকার। আর তাই মিতিন মাসি। সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যের এই উপন্যাস বাংলার ওয়ান্ডার ওম্যান করে তুলেছে এক নারী চরিত্রকে। যেখানে এবার অভিনয় করতে দেখা যাবে অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিককে। কিন্তু এই চরিত্র সম্পর্কে কয়েকটি অজানা বিষয় কিন্তু জেনে রাখা দরকার। 

মিতিন নামটি শোনামাত্রই হয়তো আপনার দিব্যদৃষ্টি কোনো শাণিত চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত যুবতী গোয়েন্দাকে কল্পনা করবে না। বাঙালি পরিবারে এমন আদুরে ডাকনামের কত মেয়েই তো রয়েছে। কিন্তু হ্যাঁ, ফেলু মিত্তির নাম থেকে যেমন প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের মস্তিষ্কের ধূসর কোষ আর টেলিপ্যাথির জোর বোঝার জো নেই, মিতিন নামটি থেকেও হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না, এ নামের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বেশ রাশভারি একটি পোশাকি নাম: প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রজ্ঞাপারমিতা হলো জ্ঞানের দেবী। এবং আমাদের প্রজ্ঞাপারমিতা তথা মিতিন মাসির জ্ঞানেরও সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। ফরেনসিক বিজ্ঞান, অপরাধীদের মনঃস্তত্ত্ব, আধুনিক কিংবা প্রাচীনকালের অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, দেশ-বিদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোককথা, শারীরবিদ্যা, ধর্মশাস্ত্র; মোটামুটি নিজের কাজে প্রয়োজন এমন সকল বিষয়েই রয়েছে তার অগাধ জ্ঞান। আবার রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চা সামলানোর মতো তথাকথিত 'মেয়েলি' কাজগুলোতেও তার চমৎকার হাত। অর্থাৎ রান্না ও চুল বাঁধা দুটোতেই সে অলরাউন্ডার। এদিকে গোয়েন্দাদের তো শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখলেই চলে না। সেই সাথে সমান প্রয়োজনীয় শারীরিক সুস্থতাও। আর সেজন্য শরীরচর্চার বিকল্প কী! মধ্য ত্রিশের মিতিন মাসি তাই নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিজেকে ফিট রাখতে ভালোবাসে।

মিতিন মাসির লুকে কোয়েল মল্লিক, Image Source: Google


ক্যারাটের প্যাঁচ পয়জারগুলো তার বেশ ভালোই নখদর্পণে। এমনিতে স্বভাবে সে শান্ত, কিন্তু শত্রুকে ঘায়েল করতে মারপিটেও তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। নিজের সাথে একটি রিভলবারও রাখে সে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গোয়েন্দাদেরও তো আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সখ্য গড়ে তুলতে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে। এ কথাও মিতিন মাসির ভালোই জানা। তাই সে নিজেই গাড়ি চালায়, কম্পিউটার চালানোটাও খুব ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছে, আর স্মার্টফোনের যুগে সবসময় একটি ওই বস্তুও নিজের সাথেই রাখে। মিতিন মাসির সাথে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের বেজায় মিল। নিছকই রহস্যের সমাধান তার উদ্দেশ্য নয়, বরং সে চায় যেকোনো ঘটনাকে তলিয়ে দেখে সেটির পেছনের প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। দেবী দুর্গার কপালের ঠিক মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করে তৃতীয় নয়ন। এই তৃতীয় নয়নের মাঝেই নাকি লুকিয়ে থাকে দেবীর দিব্যদৃষ্টি। এই তৃতীয় নয়নই আলোর পথ দেখায়, সত্যের সন্ধান দেয়। তাই সত্য উদ্ঘাটনের জন্য মিতিন মাসিও যখন প্রথম তার ডিটেক্টিভ এজেন্সি খুলেছিল, সেটির নাম দিয়েছিল তৃতীয় নয়ন। পরে অবশ্য তৃতীয় নয়ন ভাষান্তরের মাধ্যমে হয়ে যায় থার্ড আই।



মিতিন মাসির বাড়ির ঢাকুরিয়ায়। আর টুপুরদের, অর্থাৎ অবনী-সহেলিদের বাসা উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে। কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে বারবারই উঠে আসে ঢাকুরিয়া ও হাতিবাগানের প্রসঙ্গ, এবং তার মাধ্যমে প্রকট হয়ে ওঠে কলকাতা শহরের দুই অংশের জীবনযাত্রার মধ্যকার ফারাকগুলো। মিতিন মাসির কাহিনীতে পারিবারিক বন্ধন রয়েছে একটি বড় জায়গা জুড়ে। কলকাতার উচ্চ-মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের চিত্র খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তার অন্যান্য উপন্যাসে মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা ক্লেদ-কলুষতা দেখানো হলেও, এই সিরিজে মিতিন মাসি ও টুপুরদের দুইটি পরিবারের মাধ্যমে ইতিবাচক দিকগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নেতিবাচক দিক যে একেবারেই নেই তা নয়। তবে সেগুলো কাহিনীর প্রয়োজনে আসা অন্যান্য চরিত্রদের পরিবারে।
বাংলার প্রথম নারী গোয়েন্দাকে বড় পর্দায় তুলে ধরবেন অরিন্দম শীল, Image Source: Google

এবার আসা যাক এই গল্প নিয়ে যে সিনেমাটি তৈরি হচ্ছে তার কথায়। মিতিন মাসি কিন্তু একটা সিরিজ। অর্থ্যাৎ এই ছবিতে একবার কোয়েলকে দেখা যাচ্ছে মানে পরের মিতিন মাসিতেও কিন্তু তাকেই এই চরিত্রে দেখা যাবে। মিতিনের এই চরিত্রে কোয়েলকে মানিয়েছে। এমনিতেই কোয়েলের চেহারার মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত একটা ভাব। এবার অরিন্দম শীল সেটাকেই অস্ত্র করে এগিয়ে আসছেন। এর আগেও তিনি ব্যোমকেশ ও শবর করেছেন। এবং সেখানে পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতাও অনস্বীকার্য। তবে নারী গোয়েন্দার এই রূপ সৃষ্টিতে তাঁর শিল্প কতটা সফল হয় সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায়। 


দুই ধরনের দর্শকের কাছে মিতিন মাসি সিনেমাটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে। প্রথমত, ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ রয়েছে যাদের। দ্বিতীয়ত, ভ্রমণ করতে বা ভ্রমণকাহিনী পাঠ করতে ভালোবাসে যারা। মিতিন মাসির প্রায় প্রতিটি কাহিনীতেই ঐতিহাসিক রেফারেন্সের ছড়াছড়ি। কলকাতা শহরটি যে ঐতিহাসিকভাবে ঠিক কতটা সমৃদ্ধ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের কত চমকপ্রদ গলি-ঘুপচি, এই সিরিজটি না পড়লে তার অনেক কিছুই বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের অজানা থেকে যাবে। তাছাড়া কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাস করা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন ইহুদী, আর্মেনিয়ান, পারসিক, চীনা, জৈনদের সম্পর্কে বহু মূল্যবান ও অজানা তথ্যও জানা যাবে এই সিরিজ থেকে। এক কালে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে নানা জাতের মানুষেরা এসে যে ভিড় জমাত কলকাতায়, এবং তাদের অস্তিত্বের ছাপ এই একবিংশ শতকে এসেও রয়ে গেছে কলকাতার বুক জুড়ে, তা ভেবে সত্যিই অবাক হতে হবে। আর সেই অতীতের সাথে সমসাময়িককে যেভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তা-ও এক কথায় অনবদ্য।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.