"চেনা চেনা লাগছে, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি" রোগের নাম প্রসোপ্যাগনোসিয়া


Odd বাংলা ডেস্ক: অন্যান্য অন্ধতার মতো প্রসোপ্যাগনোসিয়া এতটা পরিচিত নয়। অনেকে হয়তো নাম শুনে এটি চিনতেও পারবেন না। প্রসোপ্যাগনোসিয়া হলো ফেস ব্লাইন্ডনেস বা চেহারা চিনতে পারার অক্ষমতা। এটি একধরনের স্নায়বিক সমস্যা। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে রোগীকে মানুষের চেহারা চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শুধু চেহারা নয়, স্থান, যানবাহন কিংবা মুখের সঠিক অঙ্গভঙ্গি চিহ্নিত করতেও তাদের সমস্যা হয়ে থাকে। 

কিন্তু প্রসোপ্যাগনোসিয়ার যে বিষয়টি অবাক করার মতো, তা হলো যারা এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাদের কেবল চেহারা চিনতেই সমস্যা হয়ে থাকে। অন্য কিছু চেনার ক্ষেত্রে তাদের চোখ এবং মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করে। এই বৈশিষ্ট্যই রোগটিকে গবেষকদের কাছে আরো বেশি রহস্যাবৃত এবং কৌতূহলোদ্দীপক করে তুলেছে।


আগে গবেষষকদের ধারণা ছিলো, কেবল মাথায় আঘাত পাবার কারণেই প্রসোপ্যাগনোসিয়া দেখা দিতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের এ ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়।

জার্মান নিউরোলজিস্ট জোয়াশিম বোডামের সর্বপ্রথম ১৯৪৭ সালে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার উল্লেখ করেন। তিনি এমন ২৪ বছর বয়সী এমন একজন রোগীর সন্ধান পান, যিনি মাথায় বুলেটবিদ্ধ হবার ফলে নিজের পরিচিতজনদের চেহারা মনে করতে পারছিলেন না।

তিনি এ নতুন ব্যাধিটির নাম দেন প্রসোপ্যাগনোসিয়া। প্রসোপ্যাগনোসিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দাংশ 'প্রসোপন' থেকে। এর অর্থ 'চেহারা'। মূলত চেহারা চিনতে সমস্যা হয় বলে এই সমস্যাটিকে প্রসোপ্যাগনোসিয়া নামে ডাকা হয়। তবে ফেস ব্লাইন্ডনেস কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন বিল কোয়সার, ১৯৯৬ সালে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগী মানুষের চেহারা চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন; Image Source: Google


প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ধরন গবেষকরা আগে মনে করতেন, কেবল মস্তিষ্কে আঘাত পাবার কারণেই প্রসোপ্যাগনোসিয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এখন এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, মস্তিষ্কে আঘাত ছাড়া আরো অনেক কারণে ব্যধিটি দেখা দিতে পারে। তাই প্রসোপ্যাগনোসিয়া আক্রান্ত হবার কারণের ওপর ভিত্তি করে একে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।


১. অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া: মস্তিষ্কের আঘাতের কারণে কারো মধ্যে চেহারা চিনতে পারার অক্ষমতা তৈরি হলে সেটিকে অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া বলা হয়। আমরা যেসব ফেস ব্লাইন্ডনেসের কথা শুনে থাকি, সেগুলোর বেশিরভাগই অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া। বোদেমার ১৯৪৭ সালে এই প্রসোপ্যাগনোসিয়াকেই চিহ্নিত করেছিলেন।


২. ডেভেলপমেন্টাল প্রসোপ্যাগনোসিয়া: বিভিন্ন নিউরোডেভেলপমেন্টাল কন্ডিশনের কারণে এই প্রসোপ্যাগনোসিয়া দেখা দেয়। শৈশবে শিশুর শিখন প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হলে তা ডেভেলপমেন্টাল প্রসোপ্যাগনোসিয়ায় রূপ নিতে পারে। এর সঙ্গে বংশগতির প্রভাবেরও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সমগ্র জনসংখ্যার দুই শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ডেভেলপমেন্টাল প্রসোপ্যাগনোসিয়ার সাথে জড়িত।


কেন হয় প্রসোপ্যাগনোসিয়া? যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, গবেষকেরা এখন পর্যন্ত দু'ধরনের প্রসোপ্যাগনোসিয়া আবিষ্কার করেছেন। এদের উভয়েরই পেছনে রয়েছে আলাদা আলাদা কারণ।


আমরা যখন কোনো কিছু দেখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ একটি লোব সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করার দায়িত্ব পালন করে। এই বিশেষ লোবটির নাম হলো অক্সিপিটাল লোব। গবেষকরা অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়ার সঙ্গে এই অক্সিপিটাল লোবের বিশেষ একটি অংশের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। এর নাম অক্সিপিটো-টেম্পোরাল কর্টেক্স। তাদের মতে, মস্তিষ্কের এই অংশটিতে গোলযোগ দেখা দিলে অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়ার উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। তারা আরো দেখেছেন, যাদের মস্তিষ্কের এই অংশটি সঠিকভাবে কর্মক্ষম থাকে, তাদের মধ্যে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার কোনো উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায় না।
তাদের মতে, মস্তিষ্কের অক্সিপিটো-টেম্পোরাল কর্টেক্সে একটি অঞ্চল রয়েছে, যা কোনো চেহারার উপস্থিতিতে সক্রিয় ওঠে। এর নাম ফুসিফর্ম ফেইস এরিয়া। এটি ছাড়াও সুপিরিয়র টেম্পোরাল সালকাস, অক্সিপিটাল ফেস এরিয়া এবং প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সে সমস্যা দেখা দিলে অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া হতে পারে।


অন্যদিকে, অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়ার জন্য মাথার আঘাতকে দায়ী করা হলে, ডেভেলপমেন্টাল প্রসোপ্যাগনোসিয়ার জন্য দায়ী করতে হয় বংশগতি এবং জেনেটিক অসামঞ্জস্যকে।


একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মধ্যে বিভিন্ন বস্তু চিনতে এবং শনাক্ত করতে পারার ক্ষমতা গড়ে উঠতে থাকে। সাধারণত শিশুরা যখন কোনো চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করে, তখন তার মধ্যে একটু বেশি সময় ধরে দৃষ্টি বিনিময়ের প্রবণতা দেখা যায়। এই সহজাত বৈশিষ্ট্যই শিশুর চেহারা চিনতে পারার সক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়।


কোনো কারণে এই প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হলে শিশুর চেহারা শনাক্ত করার ক্ষমতা সঠিকভাবে বিকশিত হতে ব্যর্থ হয়। ফলে ডেভেলপমেন্টাল প্রসোপ্যাগনোসিয়া দেখা দেয়।

মুখ চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু পরিচয় মনে পড়ছে না, Image Source: Google

প্রসোপ্যাগনোসিয়ার লক্ষণ কোনো মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় তাকে চিনতে না পারা। নিজের পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধুকে চিনতে অসমর্থ হওয়া । যেমন- হঠাৎ করে কোনো আত্মীয় বিদেশ থেকে চলে এলে তাকে প্রথম দেখায় চিনতে না পারা। দৈনন্দিন যেসব মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়, যেমন- এলাকার মুদি দোকানদার, নাপিত, কাজের বুয়া, ব্যক্তিগত গাড়িচালক- এদের চেহারা ভুলে যাওয়া। কেউ নিজের চেহারায় সূক্ষ্ম পরিবর্তন করলে তাকে আর চিনতে না পারা। যেমন- পরিচিত কোনো বন্ধুর চুলের রঙ কালো। এখন সে যদি চুলের রঙ লাল করিয়ে আনে, তাহলে তাকে চিনতে না পারা। কারো সাথে পরিচিত হবার পর তার পুরো চেহারা মনে না রেখে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনে রাখা। যেমন- তার নাকটা বোঁচা কিনা, তার চোখের মণি কী বর্ণের ইত্যাদি। অবস্থা বেশি গুরুতর হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেও চিনতে না পারা। একে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার শেষ ধাপ বলা যেতে পারে। শৈশব এবং প্রসোপ্যাগনোসিয়া প্রসোপ্যাগনোসিয়ার লক্ষণগুলো বড়দের ক্ষেত্রে যেমন, শিশুর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমন। কারো মধ্যে যদি শৈশব থেকে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করে, তবে তার পরবর্তী জীবন বেশ বন্ধুর হয়ে দাঁড়ায়।


কোনো শিশু প্রসোপ্যাগনোসিয়ায় আক্রান্ত হলে আশেপাশের সকলেই তার অপরিচিত ঠেকতে শুরু করে। ঠিকমতো চিনে উঠতে না পারার কারণে অনেক শিশুর মনেই এ ধারণার জন্ম নেয়, যে যারা নিজেদেরকে তার অভিভাবক বলে পরিচয় দিচ্ছে, তারা আদতে তার আসল বাবা-মা নয়। এই সন্দেহ শিশুর মনে অমূলক ভয়ের সৃষ্টি করে, যার কারণে সে পরিবার থেকে শুরু করে। শুধু বাবা-মা নয়, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেশাও তার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এ অস্বস্তি থেকে শিশুটির মনে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি জন্ম নেয়।


Blogger দ্বারা পরিচালিত.