ইংরেজ সৈনিকের এই ছেলে প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল হাজার হাজার ভারতীয়দের, আজ রসের মৃত্যুদিন


Odd বাংলা ডেস্ক: চার্লস ল্যাভেরন যদিও ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, কিন্তু তখনও জলাশয়ের ভূত আমাদের পিছু ছাড়েনি। ঠিক কীভাবে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে, এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞ ছিলেন। এমনকি ল্যাভেরনের ম্যালেরিয়া জীবনচক্রও অসম্পূর্ণ ছিল। এই অজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানকে উদ্ধার করতে দৃশ্যপটে হাজির হন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। রোনাল্ড রসের আবির্ভাবের পূর্বে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ম্যালেরিয়া গবেষণায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন গবেষকদের অনুসন্ধানের ফলে Plasmodium-এর চারটি প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। ইতালীয় বিজ্ঞানী ক্যামিলো গলগি বিভিন্ন ধরনের ম্যালেরিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেন।
এই পরীক্ষাগারেেই রস কাজ করতেন, Image Source: Google

স্যার রোনাল্ড রসের জন্ম ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের আলমোরা অঞ্চলে। তার পিতা স্যার সি সি রস তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে গ্রেট ব্রিটেনে ফেরত পাঠানো হয়। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন তিনি। যদিও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যায়ন করার কোনো অভিলাষ পোষণ করেননি, তার পিতার ইচ্ছানুযায়ী তাকে মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। জেনারেল সি সি রস স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলে ডাক্তার হয়ে ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরি করবে। চার্লস ল্যাভেরনের ন্যায় রোনাল্ড রসও একজন সামরিক ডাক্তার হয়ে উঠেন। কর্মজীবনের শুরু থেকেই রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। তিনি চার্লস ল্যাভেরন এবং প্যাট্রিক ম্যানসনের ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত জার্নাল নিয়ে কাজ করতেন। ল্যাভেরন তার এক জার্নালে ম্যালেরিয়ার সাথে মশার যোগসূত্র থাকার কথা ধারণা করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। রোনাল্ড রস ল্যাভেরনের প্রস্তাবিত তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুদিন পর রোনাল্ড রস ভারতবর্ষে বদলি হয়ে যান। পিতার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে ইংল্যাণ্ডের মায়াত্যাগ করে তিনি বোম্বের জাহাজে উঠে পড়েন। তার পিছু পিছু ম্যালেরিয়ার ভূতও ভারতবর্ষে গিয়ে পৌঁছে। তিনি সেখানে গিয়ে বেশ মজার একটি পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ম্যালেরিয়া রোগীর উপর এই পরীক্ষা শুরু করেন। প্রথমে তিনি সুরক্ষিত পরিবেশে মশার চাষ করেন। তারপর গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তিনি তাদের উপর মশা লেলিয়ে দেন। এই অভিনব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বেশ সমালোচিত হলেও তিনি থেমে যাননি। তিনি সেই মশাগুলোর দেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু সন্ধান করতে থাকেন। প্রথম দু’বছরে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। তবে ১৮৯৭ সালে তিনি রাতারাতি বেশ বড় আবিষ্কার করে ফেললেন।
Image Source: Google


সেবার রস কিছু দুর্লভ প্রজাতির মশার উপর পরীক্ষা করছিলেন। তখন তিনি মশাগুলোর পাকস্থলীতে এমন কিছু বস্তু লক্ষ্য করেন যার সাথে ম্যালেরিয়াস স্পোরোজয়েটের খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ হওয়া রস এবার আশার আলো দেখতে পান। কিন্তু ওদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রসকে সতর্কবার্তা পাঠানো হলো। এরকম অদ্ভুত অনিরাপদ গবেষণা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রসকে আদেশ প্রদান করা হলো। রস সরকারি আদেশ অমান্য করার দুঃসাহসিকতা দেখাননি। তিনি এবার মানুষের বদলে পাখির উপর গবেষণা শুরু করেন। এই ঘটনা তার জীবনে শাপে বর হয়ে ধরা দিলো। এবার রস আরো দ্রুত ম্যালেরিয়ার জীবনচক্রের অমীমাংসিত ধাঁধা সমাধান করতে সক্ষম হলেন। তিনি পাখির ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র সম্পন্ন করার পর মানুষের ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্রের পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরি করেন। রস প্রমাণ করলেন, ম্যালেরিয়া ছড়ানোর পেছনে দায়ী প্রধান পতঙ্গ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা। এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্যার রোনাল্ড রসকে ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, স্যার রস বিজ্ঞানী ল্যাভেরনের ৫ বছর পূর্বে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন। এভাবে দুই পথিকৃতের হাত ধরে প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া জীবাণুর রহস্য আমাদের নিকট ফাঁস হয়ে যায়। প্রাচীনকালের ভ্রান্ত ধারণার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বিজ্ঞান। এই দুই বিজ্ঞানীর কাজের উপর ভিত্তি করে ম্যালেরিয়ার উপর অন্যান্য যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে থাকে। বিজ্ঞানী জিওভানি বাতিস্তা এবং রবার্ট কচ ল্যাভেরন-রসের জ্ঞানকে আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যান। আবিষ্কার হয় ক্লোরোকুইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণরক্ষাকারী ঔষধ। একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে পড়লো। ১৯০৬ সালের ঘটনা। পুরোদমে পানামা খাল খননের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২৬ হাজার কর্মীর মাঝে ২১ হাজার কর্মী ম্যালেরিয়া এবং পীত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লো। কী ভয়াবহ অবস্থা! খাল খননের কাজ একেবারে বন্ধ হওয়ার যোগাড়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে খুব দ্রুত ম্যালেরিয়ার ঔষধ সেবন করা প্রয়োজন ছিল। ম্যালেরিয়া চিকিৎসার মাধ্যমে ১৯১২ সালের মধ্যে আক্রান্ত কর্মীর সংখ্যা ৫ হাজারে নামিয়ে আনা হলো। সেই যাত্রায় সবাই বেঁচে যায়। খাল খননের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলে। অথচ কয়েক বছর পূর্বেও মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে এক অজানা অজ্ঞতার অভিশাপে প্রাণ হারাতো। অন্ধের মতো জলাশয়ের ভূতকে তাড়া করতে গিয়ে যেন নিজেই পথ হারিয়ে ফেলতো। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে ল্যাভেরন এবং স্যার রসের ন্যায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। তাদের নিকট চিকিৎসা বিজ্ঞান চিরঋণী।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.