১৯৬০ সালে যখন তামিলনাডুতে দলিতদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, কিলভেনমনি ম্যাসাকার ভারতের জন্য এক লজ্জা


Odd বাংলা ডেস্ক: মানুষের চরিত্র ভুলে যাওয়া। তেমনই কিলভেনমনি হত্যাকান্ডও আজ ভারতবাসীরা ভুলতে বসেছে।  ভারতের সভ্যতা ও সমাজের এক অন্ধকার দিক হল এখানকার জাতিভেদ প্রথা। ২ জাতির মধ্যে ভেদাভেদ যেমন রয়েছে তেমনই আছে এক জাতির মধ্যেই বর্ণাশ্রম প্রথা। যেখানে নিচু জাতের মানুষদের বলা হয় যেহেতু তার জন্ম একি দলিত পরিবারে তাই তার বাঁচার অধিকার নেই। ১৯৬৮ সালে ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের কিলভেনমনি গ্রামে ঘটা হত্যাকাণ্ড এমনই এক নিষ্পেষণের উদাহরণ।

দক্ষিণ ভারতে অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ভারত স্বাধীন হবার আগে থেকেই তামিলনাড়ুতে পেরিয়ার রামস্বামী দ্রাবিড় আত্মপরিচয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছোঁয়াছুঁয়ি ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে এই ইস্যুতে বেশ কিছু সত্যাগ্রহও সংঘটিত হয়েছিলো। তবে তার ভিত্তি টলানো যায়নি। হাজার বছর ধরে চলে আসা অন্যায় দূর করার জন্য শত বছর যথেষ্ট সময় নয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশ পাওয়া একটি প্রতিবেদন, Image Source: Google


ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের নাগাপট্টিনাম জেলার একটি গ্রাম কিলভেনমনি। দক্ষিণ ভারতের প্রসিদ্ধ কাবেরি নদীর মোহনায় অবস্থিত এই গ্রামটি জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।


৬০ এর দশক চলছিলো। তামিলনাড়ুর কিলভেনমনি গ্রামে দরিদ্র কৃষিশ্রমিক আর জমির মালিকদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছিলো। ধানক্ষেতে কাজ করা মজুররা আগের চেয়ে একটু ভালো থাকার আশায় কিছু বেশি মজুরি দাবি করেছিলো। বর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে দলিত ও অস্পৃশ্যদের বেঁচে থাকাই একরকম বিস্ময়, সেখানে বেশি মজুরির দাবি তোলা একরকম দুঃসাহসের পরিচয়ই বলা যায়। ভারতে তখন সরকারের নেওয়া ‘কৃষি বিপ্লব’ কর্মসূচীর কারণে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্য বেড়ে গিয়েছিলো। ১৯৫৫ সালে প্রদেশে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও কৃষি মজুরদের অবস্থার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। কারণ জমিদারি আমলে তারা বাধ্যতামূলক মজুরি করতো, আর তা উচ্ছেদ হবার পর তারা হয়ে গেলো দিনমজুর। এছাড়া কৃষিজমির একটা বড় অংশ গ্রামাঞ্চলের মন্দির কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করতো। ফলে গরিব কৃষি শ্রমিকরা আর্থিক বৈষম্যের সাথে আরো বেশি করে সামাজিক অমর্যাদারও শিকার হতো। 

৪২ জন মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল, Image Source: Google

 ১৯৬৬ সালে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলে ধানের ফলন কিছুটা কম হয়েছিলো। কৃষি মজুরদের দুর্দশার কারণে তাদের মধ্যে বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী রাজনীতির প্রভাব বেড়ে চললো। বিশেষ করে সিপিআইএম এ অঞ্চলে তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম অনেকটা প্রসারিত করেছিলো। ধানের বর্ধিত মূল্যের কারণে মজুররা আগের চেয়ে কিছু বেশি মজুরি দাবি করলে জমির মালিকপক্ষ এককথায় তা অস্বীকার করে। বঞ্চনার কারণে দলিত কৃষি মজুররা নিদারুণ ক্ষুব্ধ হয়। অধিকার আদায়ের জন্য তারা সংগঠিত হতে থাকে। জমির মালিকগোষ্ঠীও বসে ছিলো না। তারাও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একত্রিত হলো। ‘Paddy Producers Association’ নামের সংগঠন সামনে রেখে তারাও দলিত মজুরদের বিরুদ্ধে একত্রিত হলো। কম্যুনিস্ট পার্টির কৃষক শাখার সাথে সেখানকার কৃষি মজুরদের অনেকেই জড়িত ছিলো। মালিকগোষ্ঠী বামপন্থী মজুরদের কাজ থেকে বের করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু এই বিভেদ নীতি খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি। দলিত মজুররা তাদের পাওনার দাবিতে একরকম অটল রইলো। এবার জমির মালিকগোষ্ঠী অন্য পথ ধরলো। গ্রামের মজুরদের চোখে ধুলো দেবার জন্য অন্য অঞ্চল থেকে মজুর এনে ধান কাটার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু গ্রামের মজুরদের আগের পাওনার সুরাহা না হওয়ায় তারা এই পদক্ষেপ মেনে নিলো না। তারা প্রতিরোধের পথে গেলো। গ্রামের কৃষকদের সাথে সংঘর্ষে বহিরাগত মজুরদের মধ্যে পাক্কিরিস্বামী পিল্লাই নামে একজন নিহত হলো। বামপন্থী সংগঠনের সাথে জড়িত আরো কয়েকজন কৃষি মজুরও এই ঘটনায় প্রাণ হারালেন। 

দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন, Image Source: Google

পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলো। গ্রামের জমির মালিকদের সংগঠন কৃষকদের প্রকাশ্যে হুমকি দিতে লাগলো। ১৯৬৮ সালের ১৫ নভেম্বর গ্রামের দলিত মজুরদের পক্ষ থেকে তামিলনাড়ু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আন্নাদুরাইয়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। তা যথাসময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছায়নি। ধারণা করা হয়, জমির মালিকপক্ষের কারসাজিতে তা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছতে দেরি হয়েছিলো। সেদিন ছিলো ১৯৬৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর। রাত ১০টার দিকে পুলিশের গাড়িতে করে কিলভেনমনি গ্রামে একদল ঘাতক প্রবেশ করলো। তারা গ্রামে দলিত মজুরদের বসবাসের এলাকাগুলো ঘিরে ফেললো। অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের পালানোর সব পথ বন্ধ করা হলো। নির্বিচারে গুলি চালানো ছাড়াও কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। ফলে আগুনে পুড়ে কয়েকটি পুরো পরিবার নিহত হলো।

তথ্যসূত্র: Kurudhippunal by Indira Parthasarathy
Blogger দ্বারা পরিচালিত.