সত্যজিৎ রায় যদি কল্পনা করে থাকেন, তার রূপ দিয়েছিলেন সুব্রত মিত্র, আজ তার জন্মদিন


Odd বাংলা ডেস্ক: একটি সাদা-কালো বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ে চায়ের লিকারের রং যথাযথ পাওয়ার জন্য সুব্রত মিত্র অকাতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সে সময় উন্নাসিকেরা দূর থেকে হয়তো ভেবেছে- ভদ্রলোকের মাথায় সমস্যা আছে। নিখুঁত হওয়ার জন্য সুব্রত মিত্রের অনুশীলনকে হয়তো বাড়াবাড়ি রকমের বাতিক বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল অনেকের কাছে। তাইতো তিনি পথের পাঁচালী বা চারুলতার মতো অসামান্য ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। তাঁকে বুঝতে একটু সময় লাগবে- সেটাই স্বাভাবিক । সাহেবদের হাত ধরে এদেশে যন্ত্র এসেছিল বলেই হয়তো যন্ত্র প্রসঙ্গে আমাদের সীমাহীন উদাসীনতা। হয়তো সুব্রত মিত্র কিছুটা যন্ত্রপাগল ছিলেন সত্যি। তবে আমরাতো প্রত্যক্ষ করেছি আমৃত্যু তাঁর সিনেমাটোগ্রাফির পাগলামির কারুশিল্প, তাইতো প্রয়াত সুব্রত মিত্র প্রকৃতই অযান্ত্রিক।

সুব্রত মিত্র একটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১২ অক্টোবর ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি সহপাঠীদের সাথে কাছাকাছি সিনেমা হলে ব্রিটিশ এবং হলিউডের চলচ্চিত্র দেখতেন । কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ঠিক করেন তিনি একজন আর্কিটেক্ট নয়তো একজন চিত্রগ্রাহক হবেন । তিনি ক্যামেরা সহকারীর কোন কাজ না পেয়ে বিজ্ঞানে ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করতে থাকেন । ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসাবে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা হয় ।
সুব্রত মিত্রকে সিন বোঝাচ্ছেন মানিকবাবু (Image Source: Google)

সুব্রত মিত্রের নিজের ভাষ্যমতে, গ্রেট এক্সপেকটেশনস (১৯৪৬) ও অলিভার টুইস্ট (১৯৪৮)– চার্লস ডিকেন্সের এই কাহিনী দুটি তাঁকে খুব আকর্ষণ করেছিল। কাহিনী দুটির চিত্ররূপ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লিন। তিনি দেখলেন উপন্যাসের আখ্যান চলচ্চিত্রে বদলে যাচ্ছে। কাহিনীর চাইতেও তাঁর কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো গাই গ্রিনের অল্প আলোর লাইটিং। পরের বছর দেখলেন পরিচালক ক্যারল রিডের দি থার্ড ম্যান (১৯৪৯)। এখানেও সুব্রত মিত্রের মনে বেশি রেখাপাত করলো রবার্ট ক্রাসকারের সিনেমাটোগ্রাফি। এরপর ১৯৪৭ সালে 'মঁসিয়ো ভিনসেন্ট' চলচ্চিত্র দেখার সময় বুঁদ হয়ে গেলেন ক্লোদ রনোয়ার অস্বাভাবিক ক্যামেরা নৈপুণ্যে। স্বপ্নে-জাগরণে ক্যামেরা তাকে হাতছানি দিতে শুরু করল। আর বলতে গেলে একদম কাকতালীয় ভাবেই একটি অঘটন ঘটে গেল কিছুদিন পরেই। স্বয়ং ক্লোদ রনোয়ার সঙ্গে তরুণ সুব্রত মিত্রের দেখা হয়ে গেল খোদ কলকাতার রৌদ্রালোকিত রাজপথে। আসলে সিনেমার ইতিহাসে যিনি দেবতার মর্যাদা পান, ফরাসি দেশের অবিনশ্বর চলচ্চিত্রস্রষ্টা জঁ রনোয়া 'দ্য রিভার' ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চিত্রগ্রাহক ভাইপো ক্লোদ রনোয়া। প্রথমে সুব্রত নিজেই চেষ্টা করে বিফল হন, অবশেষে তাঁর বাবার সর্নিবন্ধ অনুরোধে জঁ রনোয়া নেহাতই দরাপরবশ হয়ে সুব্রতকে ‘অবজার্ভার’ হিসেবে থাকার অনুমতি দিলেন। সুব্রত তখন ক্লান্তিহীন, ছবি এঁকে এঁকে আলোর ব্যবহার, অভিনেতাদের চলাচল, ক্যামেরার অবস্থান সম্পর্কে অবিরত নোট নিতে থাকলেন। একদিন তাঁর ডাক পড়ল ভিতর সভার মাঝে। স্বয়ং জঁ রনোয়া মুগ্ধ হয়েছেন তার পর্যবেক্ষণে। এরপর ক্লোদ রনোয়া লাইট কনটিউনিটির জন্য সুব্রত মিত্রের এই খাতার শরণাপন্ন হলেন। এই ছবি বস্তুত ভারতীয় চলচ্চিত্রে আধুনিকতার আঁতুড়ঘর। এখানেই সুব্রতর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের– যিনি সেটের কাজ করেছিলেন। আর এখানেই রবিবার, সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে, শুটিং দেখতে আসতেন তরুণ চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী সত্যজিৎ রায়। সুব্রত আগন্তুককে অক্লান্তভাবে বুঝিয়ে যেতেন বাস্তবের অনুপুঙ্খ। অবশেষে সত্যজিৎ মেনে নিলেন– ‘আপনার দেখার চোখ এখন সম্পূর্ণ’। আর তাই মাত্র একুশ বছর বয়সে, কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অথবা, শুধু স্থিরচিত্রের অভিজ্ঞতা নিয়েই, সুব্রত মিত্র দায়িত্ব নিলেন সেই ছবির চিত্রগ্রহণের - যা বিশ্বচলচ্চিত্রের একটি মাইলষ্টোন বলে আজও খ্যাত। ভূমিষ্ঠ হলো 'পথের পাঁচালী'। 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্রে কাজ করার আগে চলচ্চিত্র ক্যামেরার ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। 'দ্য রিভার' ছবিতে পর্যবেক্ষক হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি পথের পাঁচালীর চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । পথের পাঁচালী থেকে 'নায়ক'- সত্যজিৎ রায়ের এই দশটি ছবি ছাড়াও তিনি অন্য পরিচালকের বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন ।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.