সাহানা থেকে উল্টোরথ, বাঙালির সিনেমা গসিপ ম্যাগাজিনের ইতিহাস


Odd বাংলা ডেস্ক: "অপরাজিত" উপন্যাসে কলকাতা শহরে অপু পা দিয়েই প্রথম বলেছিল -বায়োস্কোপ যেখানে হয়, এখান থেকে কতদূর? আর সেই দিনটা থেকেই হয়তো তিলোত্তমার কপালে সিনেমা জুটবে সেটা লেখা হয়ে গিয়েছিল। একটা সময় সংস্কৃতিপন্থীরা বলেছিল চলচ্চিত্র এক লঘু চিত্র বিনোদন মাত্র। কিন্তু তখনও তো টেলিভিশন আসে নি। অতএব সিনেমা দেখতে হলে যেতে হবে প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু সিনেমাকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালি বিছানাতেও শুতে চাইছে। নিজের প্রিয় নায়ককে দেখে বাঙালি তরুণী রাতের আঁধারে স্বপ্ন বুনতে চাইছে। তার জন্য দরকার নিজের প্রিয় অভিনেতার ছবি নিজের কাছে রাখা। 


আবার বাঙালি তরুণ তাঁর প্রিয় নায়িকার প্রত্যেকদিনের রুটিন জানতে চাইছে। কোন সাবান মাখেন, কী এমন খান যে এত সুন্দরী তিনি। ব্যাস আর কি! বাঙালি প্রমথেশ বড়ুয়াকে অনুকরন করে কলারতোলা পাঞ্জাবি পরতে শিখল আর কাননবালাকে দেখে বাঙালি তরুনীক কপালে এল অনুরাধা টিপ। 

কলকাতার বুকে সিনেমা ঐতিহ্যে ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস কিন্তু অনস্বীকার্য।  ঠাকুরবাড়ি থেকেই তথাকথিত প্রথম সিনেমা ম্যাগাজিনটা প্রকাশ পেল। পুরোপুরি সিনেমা নিয়ে লেখা না থাকলেও বেশ কয়েকটি পাতাতে সিনেমার কথা ও গল্প প্রকাশ পেল। পত্রিকার নাম 'ভারতী'। প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে রবীন্দ্র নিজেও এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু প্রথম প্রকৃত সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ পেল ১৯২৫ সালের গ্রীষ্মে। সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও হেমেন্দ্রকুমার রায়। নাম নাচঘর। বাঙালি যেন নিজের পকেটে করে বিনোদন নিয়ে ঘুরতে শুরু করে দিল। 

অন্যদিকে আবার ১৯২৯ সালে বায়োস্কোপ পত্রিকাটি প্রকাশ পেল। এটির পর এল আরও একটি সিনেমা পত্রিকা। সেটা আবার দ্বিভাষিক। নাম দীপালী। বিভূতিভূষণ নিজেও একটি সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এর নাম চলচ্চিতত্র। কলকাতার পাশপাশি ঢাকা থেকেও প্রকাশ পেতে থাকলো সাময়িকী সিনেমা পত্রিকা চিত্রকথা। ১৯৪০ প্রকাশ পাওয়া রূপলেখা সিনেমা পত্রিকার উন্নত উদাহরন।  

এছাড়ও ১৯৩১ সালে জন্ম নিল আরও দুটি সিনেমা পত্রিকা। অবিনাশ চন্দ্র ঘোষালের সম্পাদনায় বাংলা সাপ্তাহিক 'বাতায়ন' এবং বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (পথের পাঁচালীর বিভূতি নন) সম্পাদিত 'চিত্রলেখা'। পত্র-পত্রিকার ইতিহাসে এই বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই সিনেমা পত্রিকা দুটির জন্য নয়। এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ এই বছরই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত বিখ্যাত সাহিত্য ত্রৈমসিক 'পরিচয়'-এর জন্ম হয়।

১৯৩২ সালে অবনী বসু শুরু করলেন মাসিক 'চিত্রপঞ্জী' যেখানে অন্যান্য লেখার সঙ্গে সে যুগের চলচ্চিত্রকারদের সুচিন্তিত প্রবন্ধ ছাপা হত।

১৯৩৪ সালে শুরু হল জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত সিনেমা সাপ্তাহিক 'রূপরেখা'। প্রসঙ্গতঃ আরেকটি পত্রিকা ঐ একই বছরে চালু হয়েছিল - যা আজও চলছে। সেটি হল আনন্দগোষ্ঠীর 'দেশ' পত্রিকা।

১৯৩৫ সালে কোনো অবশ্য সিনেমা পত্রিকা জন্ম নেয় নি, কিন্তু বছরটাকে বাদ দিতে পারছি না, কারণ ঐ বছরই প্রথম প্রকাশিত হল বাংলা কাব্যজগতের আরেকটি রত্ন বুদ্ধদেব বসু ও সমর সেন সম্পাদিত 'কবিতা'।

১৯৩৭ সালে জগজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সিনেমা সাপ্তাহিক 'খেয়ালী' প্রকাশ শুরু করলেন।


১৯৪৩ সালে কালীশ মুখোপাধ্যায় শুরু করলেন মোটামুটি উচ্চমানের একটি সিনেমা মাসিক পত্রিকা 'রূপমঞ্চ'। এতে সে সময়কার চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদির মননশীল সমালোচনা থাকতো। সাধারণভাবে চলচ্চিত্রকলা সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা ছিল এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য।

১৯৪৭ সালে শুরু হল 'রূপাঞ্জলী' - শুধাংশু বসুর সম্পদনায়।

সিনেমা পত্রিকার প্রতি বাঙালির যে উন্মাদনা ছিল তা প্রকাশ পায় এই দুষ্প্রাপ্য ছবিটি থেকে।  এবং ফটোফিচারটির সঙ্গে কিছু লেখাও প্রকাশ পেয়েছিল। 


শিল্প সিনেমা জরুরি, কিন্তু এই শিল্পের নেপথ্যের কথা শোনার জন্য গসিপ কলাম ও পত্রিকা জরুরি। আজ যে সিনেমা ম্যাগাজিন বা এন্টারটেইনমেন্ট পোর্টালগুলি চলছে বা সিনেমা নিয়ে লেখা হচ্ছে তা আসলে বিজ্ঞাপনদ্রব্য। তাতে কোনো আনন্দ নেই। অজানা কথা নেই। হয়তো বর্তমানের তারকারাও আর আগের মতো নিজের জীবন নিয়ে সততা দেখাচ্ছেন না। তাই এঁরাও লিখতে পারছে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এই শহর এই বাংলা সিনেমা ইন্ডাষ্ট্রিই কিন্তু একটা সময় এর আনুসঙ্গিক শিল্প সিনেমা পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীর।    

[এই বিশেষ প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিগুলি আসলে oddbangla.com এর আর্কাইভে থাকা সিনেমা ম্যাগাজিনগুলির আসল সংখ্যার। অনুমতি ছাড়া এই ছবি ব্যবহার বা প্রকাশ নিষিদ্ধ।]
Blogger দ্বারা পরিচালিত.