গাইসালের সেই রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতির দলিল



Odd বাংলা ডেস্ক: রাত ১টা বেজে ৩০ মিনিট তখন। প্রচন্ড বৃষ্টি উত্তরবঙ্গ জুড়ে। তারই মাঝে আঁধারের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে 4055 ডাউন ব্রহ্মপুত্র মেল। ট্রেনের প্রত্যেকটা বগিতেই প্রচন্ড ভীড় ছিল। যাত্রীরা ট্রেনের মেঝেতেও শুয়ে ছিলেন। যাত্রীদের অনেকেই বাথরুমের দরজা খুলে সেখানেও ঢুকে পড়েছিলেন। ট্রেনটি তখন গাইসাল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। অন্যদিকে কিষানগঞ্জ স্টেশনে তখন দাঁড়িয়ে আছে আপ 5610 অবধ আসাম এক্সপ্রেস। এরই মাঝে গাইসালের পশ্চিম প্রান্তের কেবিনে তখন আউট পোস্টে ডিউটি করছে মারান্ডি। বাইরে বৃষ্টি। অন্যদিকে কেবিনের ভেতরে ইলেকট্রিসিটি নেই।  মারান্ডির একটু ঘুম ঘুম অনুভব হচ্ছিল। কিন্তু ঘুম আসার আগেই তার কানে এল ভয়ঙ্কর আওয়াজ। যেন কেউ একটা আস্ত বোমা ফাটিয়েছে তাঁর কেবিনের বাইরে।


কিছু বোঝার আগেই দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। আর এক একটি বগি ৫০ ফুট লাফিয়ে গিয়ে পড়ে আরেকটি বগির ওপর। কিন্তু আশ্চর্য্য ভাবে বগিটা এভাবে লাফালেও তার যাত্রীদের কিন্তু তেমন বিশেষ কিছু হয়নি। তবে তারপরেই একটি বগিতে একটা বিস্ফোরণ হয়। আর তাতে কারও হাত, কারও পা আবার মাথা ছিটকে গিয়ে পড়ে লাইনের পাশে থাকা জঙ্গলে। ভেসে আসতে থাকে আর্তনাদ। বাঁচার চেষ্টা করতে থাকেন কিছু মানুষ। কিন্তু কেবিনে বসে থাকা মারান্ডির তখন হাতে কিছু নেই। তার কাছে একটাই সুযোগ ছিল। আর সেটা হল পালানোর। সে পালালো কেবিন ছেড়ে। অন্যদিকে একটু জলের জন্য কাটা হাত-পা নিয়ে যাত্রীরা তখন এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। অন্যদিকে অ্যাসিসটেন্ট স্টেশন মাস্টার আর এন সিং নিজেও খবর জানতে পেরে স্টেশন ছেড়ে পালায়। যাত্রীরা তখন ফাঁকা মাঠের মাঝে আর্তনাদ করছে। তখনও মোবাইল ফোন তো আসেনি।

কিন্তু এই দুর্ঘটনা হওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। কারন একটা ভুল করে দেওয়া হয়েছিল রেলওয়ে কর্মচারীদের তরফে অনেক আগেই। আসলে গাইসাল ও কিষানগঞ্জের মাঝে পঞ্জিপাড়া স্টেশন পড়ে। কিষানগঞ্জ থেকে যখন অবধ আসাম এক্সপ্রেস রওনা দেয় তখন একজন লাইন ম্যানের উচিত ছিল লাইনের ইন্টারলকিং সিস্টেমে গিয়ে ট্রেনটিকে আপ লাইনে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কিষানগঞ্জের স্টেশন মাস্টার এইচ এন সিং বিষয়টি ভুলে যান। আর এখানেই হয়ে যায় প্রথম ভুল।
মৃতদেহগুলির কোনোটার মাথা ছিল না তো কোনোটার হাত-পা, এনডিআরএফের কর্মীরাও চমকে উঠছিল, Image Source: Google


ট্রেন চলতে শুরু করে ডাউন লাইন ধরে। এরপর এইচ এন সিং দ্বিতীয় ভুলটি করে বসেন। পঞ্জিপাড়ার কেবিনে ফোন করে তিনি নিয়মিত যে তথ্য আদানপ্রদান করতে হয় সেটা তিনি করেন। এবং বলেন অবধ আসাম এক্সপ্রেস আপ লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে ট্রেনটি তখন চলছিল ডাউন লাইন ধরে । অন্যদিকে বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। ফলে ট্রেনের ইঞ্জিনের কাঁচে তখন ওয়াইপার চলছে। পঞ্জিপাড়ার কেবিনের কর্মচারীও টর্চ দিয়ে সিগনাল দিয়ে বলে ট্রেনটিকে নিজের গতিতেই এগিয়ে যেতে। অন্যদিকে গাইসাল থেকে তখন ব্রহ্মপুত্র মেল ডাউন লাইন ধরেই এগিয়ে আসছে। কেবিনম্যান বা অবধ আসমের ড্রাইভার তারা কেউ একবার জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেনি যে ট্রেনটি আপ লাইন নয় ডাউন লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে। ট্রেনটি তখন ৮০-১০০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে চলেছে। এই গতিতে থাকা একটি ট্রেনকে থামাতে গেলে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার আগে ব্রেকের লিভার কষতে হয়।

তারপরেই রাত ১টা ৪৫ নাগাদ মুখোমুখি ধাক্কা লাগে অবধ আসাম এক্সপ্রেস ও ব্রহ্মপুত্র মেলের। সেই সংঘর্ষ এতটাই ভয়ঙ্কর যে যাত্রীদের অনেকেই লাফিয়ে গিয়ে পড়েন অন্য যাত্রীদের ওপর। ভোর রাতের আগে ঘটনাস্থলে তেমন কেউ আসেনি। ভোর হতেই খবর ছড়িয়ে পরে। রাত ৩টে নাগাদ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয় ঘটনাস্থলে। তেমনই এক অম্বুলেন্স চালক তৈমুর আলি বলছেন,

"আমি যখন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পৌছালাম তখন চারিদিকে দেহের নানান টুকরো পড়ে আছে, সবার দিকে তাকানো সম্ভব হচ্ছিল না। যারা আহত ও বেঁচে আছে তাদের আগে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। কর্মী যথেষ্ট ছিল না।"         

 অন্যদিকে সকাল হতেই শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক লড়াই। সে সময় কেন্দ্রে ছিল অটল বিহারী সরকার। রেলমন্ত্রী নীতিশ কুমার দুপুর ৩টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌছান। কিন্তু তার সামনে হাজির হয় বিক্ষুব্ধ জনতা। দিল্লি ফেরার পর নীতিশ কুমার নিজের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। অন্যদিকে সেখানে পৌছে যান আরজেডি নেতা তাসলিমুদ্দিন। মৃতের স্তুপের মাঝেই তাঁর সমর্থকরা শুরু করে দেন স্লোগান। তসলিমুদ্দিন জিন্দাবাদ, নীতিশ কুমার মুর্দাবাদ।


সেদিন আরও একজন নিজের দুরদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পৌছে যান। তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ১৫ মিনিট সেখানে থাকেন এবং নিজের চেনা স্বভাবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলে যান। রেল কর্তৃপক্ষ হিসেব দেয় প্রায় ১০০০ লোক মারা যায় গাইসাল রেল দুর্ঘটনাতে। কিন্তু এই হিসেবটা ছিল সিট সংখ্যার হিসেবে। সেদিনের ট্রেনে প্রচুর মানুষ মেঝে বসে ছিলেন যেদের কোনো রিজার্ভেশন ছিল না। তাদের হিসেব আজও মেলেনি রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ধ্বংস স্তুপ সরানোর সময় এমন অনেক দেহের টুকরো মেলে যার পরিচয় জানা যায়নি। গাইসাল এখনও পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে বড়ো রেল দুর্ঘটনা।

  
Blogger দ্বারা পরিচালিত.