এক হয়েছিল বার্লিন, বিভাজন নয় ঐক্যই পৃথিবীকে বাঁচাবে শিখিয়েছিল শিশুরা


Odd বাংলা ডেস্ক: সাল ১৯৬১, জার্মান গণপ্রজাতান্ত্রিক-এ কমিউনিস্ট সরকার পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কাঁটাতার ও কংক্রিটের মিশেলে তৈরি করা হয় প্রাচীর, যা ইতিহাসের পাতায় বার্লিনের প্রাচীর নামে খ্যাত। এই প্রাচীর হল দুটি ভিন্ন ধারার আদর্শের মধ্যেকার একটা বিভাজন রেখা। বার্লিনকে বিভক্ত করার জন্য যে দেওয়াল নির্মাণ শুরু হয়, তার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, পশ্চিমা ফ্যাসিস্টরা যাতে পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশ করতে না পারে। 

কিন্তু আদতে যা ঘটেছিল, তা এর ঠিক উল্টো। পশ্চিমারা যতজন পূর্বে প্রবেশ করেছিল, তাদের থেকে  নেক বেশি সংখ্যক পূর্ব জার্মানির অধিবাসীরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানিতে। এরপর ১৯৮৯ সালে আজকের দিনে অর্থাৎ ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট দলের প্রধানের তরফে ঘোষণা করা হয় এখন থেকে পূর্ব জার্মানির মানুষরা যখন চান সীমানা অতিক্রম করে অন্য পাশে যেতে পারেন। আর এইভাবেই পতন হয় ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীরের। বহু মানুষ আবার হাতুড়ির ঘায়ে ভাঙার চেষ্টা করছিলেন এই প্রাচীর। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম নিদর্শন হিসাবে বার্লিনের এই প্রাচীর ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান পেয়েছে। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানি হেরে গেল তা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে ব্রিটেন, যুক্ররাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্রান্সের দখলে চলে যায়। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের অংশ মিলিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব জার্মানি। প্রসঙ্গত ইয়ল্টা এবং পটসডমে অনুষ্ঠিত তিনটি সম্মেলনে স্থির করা হয় জার্মানি কটি ভাগে বিভক্ত হবে এবং কোন অংশ কার দখলে থাকবে। সেই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতা জোসেফ স্ট্যালিন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার ফাঁকেই ১৯৪২ সাল থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে মিত্র বাহিনীর পক্ষগুলোর মধ্যে টানাপোড়ন শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর জয় যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে আসে, তখন যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্গঠন এবং যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে বিপরীত অবস্থান নিতে শুরু করে। যুদ্ধোত্তর জার্মানি এই দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। জন্ম হয় দুটি স্বাধীন জার্মান রাষ্ট্রের। ব্যাপারটা কিছুটা ওই নর্থ ও সাউথ কোরিয়ার মতোই।

১৯৬১ সালের গোড়া থেকেই চারদিকে বলাবলি শুরু হয়, পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করার জন্য পূর্ব জার্মানির সরকার আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। পূর্ব জার্মানির সরকার শুরুতে বার্লিনের ভেতর কোনো দেয়াল তৈরির পরিকল্পনা নাকচ করে দিলেও সেই বছরের ১২-১৩ আগস্ট রাতের আঁধারে তারা বার্লিন শহরের বিভাজন রেখা অনুসারে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়ে দেয় এবং পশ্চিম বার্লিনকে চারপাশ থেকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। উভয় শহরের ভেতর চলাচলের মূল পয়েন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। বার্লিনবাসী পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তারা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশী থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে এই কাঁটাতারের জায়গায় কংক্রিটের দেয়াল গড়ে ওঠে। বার্লিন দেয়াল মূলত দুই প্রস্থ দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত ছিলো, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। দেয়ালের উচ্চতা ছিল ১৩ ফুট। পুরো দেয়াল জুড়ে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব জার্মান সেনাদের বলা হয়েছিল কেউ দেয়াল টপকে পশ্চিম বার্লিনে পালানোর চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে তাকে হত্যা করতে। ১৯৮৯ সাল নাগাদ দেয়াল ঘেঁষে ৩০২টি ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়। দেয়ালটির ২৮ বছরের ইতিহাসে শতাধিক লোক পালাতে গিয়ে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়।
প্রেমিকের বাড়ি প্রাচীরের ওপারে, ওদের বন্ধুরাও ওপারে Image Source: History.com

এরপরেই সেখানে একটা জনমত গঠন হতে থাকে। যাঁরা দুই বার্লিনের মিলনের পক্ষে ছিল। গান গাইতে থাকে তাঁরা। এমন কি কেউ কেউ    ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পট পরিবর্তন হতে শুরু করলে তা পূর্ব জার্মানিকেও ধাক্কা দেয়। গণ দাবীর মুখে পূর্ব জার্মানির সরকার তার নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণের উপর আরোপ করা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে বাধ্য হয়। সেই বছরের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, এখন থেকে পূর্ব জার্মানির নাগরিকরা বিনা বাঁধায় পশ্চিম জার্মানিতে ভ্রমণ করতে পারবে। তবে এ ধরনের ভ্রমণে যে কিছু বিধি নিষেধও আছে তা তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বললেন না। এদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরো ঘটনা না জেনেই প্রচার করতে শুরু করে, বার্লিন সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এ ঘোষণার সাথে সাথে উভয় বার্লিনের লোকেরা প্রাচীরের দুই পাশে জড়ো হতে শুরু করে। হঠাৎ করে এত বিপুল মানুষের উপস্থিতি পূর্ব জার্মান সীমান্ত চৌকির সেনাদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। করণীয় সম্পর্কে তারা বারবার উপর মহলের কাছে জানতে চাইলেও মানুষের জনস্রোতের উপর শক্তি প্রয়োগ করে রক্তপাত করার দায় পূর্ব জার্মান সরকারের কোনো নেতা নিতে রাজি হলেন না। একসময় সীমান্ত চৌকির সেনা অফিসাররা অনেকটা নিজস্ব সিদ্ধান্তেই বিনা পাসপোর্টে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভ্রমণের অনুমতি দিতে শুরু করে। ফলে উভয় অংশের যাতায়াতে পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তা সেদিন থেকে ফুরিয়ে যায়, আর উৎসাহী তরুণরা সেদিনই শুরু করে দেয়াল ভাঙার কাজ।

বার্লিন প্রাচীরের পতন কেবলই দুই জার্মানির এক হওয়ার গল্প নয়। এই দেয়াল ছিল স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বিবাদমান দুই পক্ষের বিভাজনের প্রতীক, যার এক পাশে ছিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, আর অপরপাশে একদলীয় সমাজতন্ত্র। সবকিছুর ওপর মানবতার জয় হওয়াটা খুব দরকার ছিল।  
Blogger দ্বারা পরিচালিত.