আজিজুন বাই: যে মুসলমান বাইজিকে সমাজ 'বেশ্যা' বললেও, তিনি দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন


বিক্রম পাঠক: অমরাবতীর পথে ভেসে চলেছেন স্বামীর মৃতদেহ ভেলায় নিয়ে বেহুলা সুন্দরী। দেবতাদের কাছে চাইলেন মৃত স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা। দেবলোকে পৌঁছে বেহুলা তাঁর অপূর্ব নৃত্যগীতে লাভ করে দেবতাদের প্রসন্নতা। ফিরে পেলেন স্বামী লখিন্দরের প্রাণ। নর্তকী ছিলেন না বেহুলা। ছিলেন ধনিক-বণিকের ঘরের কুলবধূ। কিন্তু ৬৪ কলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলা নৃত্যবিদ্যাটি ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন তিনি।

নৃত্যবিদ্যার সমাজতাত্ত্বিক দিকটি সেসময় ছিল ভিন্ন ঘরনার। মধ্যযুগেও নাচ-গানের চর্চা বাংলার উচ্চকোটি সমাজের অন্তঃপুরেও আদৃত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়  ভারত জুড়ে ক্রমেই এই পেশাকে বেশ্যা বৃত্তির আখ্যা দেওয়া হতে থাকে। ফলে ভারতের ইতিহাস যেটা মূলত স্বাধীনতার পর রচিত, তাতে আজিজুন বাইয়ের মতো মানুষ জায়গা করে নিতে পারেনি।  কারন সমাজে তারা তখন ব্রাত্য। 

অথচ সিপাহী বিদ্রোহের আগে পর্যন্তও এই পেশা ছিল শিল্পকলারই একটা দিক। দক্ষিণে এটাকে দেবদাসী বলা হত। উত্তরে তাওয়াইফ, গোয়াতে নাইকিন আর বাংলায় বাইজি।  নৃত্যকলা ও সঙ্গীত পরিবেশন করা তাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ঠিকই। কিন্তু ইংরেজরা প্রথমবার নৃত্যকলার মাঝেই তাদের গায়ে হাত দিতে থাকে। যৌন সঙ্গমে বাধ্য করতে থাকে ইংরেজরা। ক্রমেই শিল্পের দেবীরা শরীর ব্যবসার দোকানিতে পরিণত হয়।    

কিন্তু এই অবক্ষয়ের মাঝেও একজন ছিলেন। আর তিনি হলেন আজিজুন বাই। সমাজের বুকে তখন বাইজিদের আর কোনো সম্মান ছিল না। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি দেশের জন্য যা করেছেন তা ইতিহাসে তেমন ভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। মূলত কিছু লোক কাহিনী ও কিছু রিসার্চ পেপার থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়।   আজিজুন বাই লক্ষ্মৌয়ের তাওয়াইফখানাতে (বাইজিখানা) খুব কম বয়সে এসেছিলেন। এবং শারীরিক শোষন হতে থাকে তার ওপর। কিনতু তাঁর শরীরটাকেই তিনি হাতিয়ার করলেন। বললেন এই দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াতে হবেই। আজিজুন গোয়েন্দাদের মতো কাজ করতেন। সুরার নেশায় বুঁদ ইংরেজদের পেট থেকে কথা বের করে আনতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বহু ইংরেজ সাহেবকে তিনি নিজের প্রেমিকে পরিনত করে হত্যাও করেছিলেন।    



তাওয়াইফখানা পরিণত হল বেশ্যাখানায়

১৮৫৭ সালের আগে পর্যন্তও শেষ মুঘলরা তাওয়াইফদের শিল্পকে সমাদর করতেন। তারা তখনও নিজেদের গান-বাজনার অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্ত হওয়ার পরেই তাদের সেই সামাজিক সম্মান হারিয়ে যায়। বহু তাওয়াইফ দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌয়ে চলে আসে। সেখানে আউধের শেষ মুঘলরা তবু তাওয়াইফদের শিল্পের প্রতি সমাদর দেখিয়ে তাদের বিশেষ থাকার জায়গা করে দেয়। কিন্তু অবশেষে সেগুলি কোঠায় (বেশ্যাখানা) পরিনত হয়।

আজিজুন বাই নিজের মতোই আরও কিছু তাওয়াইফকে জোগার করে কোঠাগুলিকেই বিপ্লবের আস্তানা করে তোলেন। সেখানেই কোঠাগুলির মধ্যেই গুপ্ত মিটিং চালাতে থাকে বিপ্লবীরা। ক্রমেই সেখান থেকে অস্ত্র সরবরাহও হতে থাকে। শোনা যায় ভগৎ সিং নিজেও তাওয়াইফখানা থেকে নিজের বিপ্লবের পরিচালনা করেছিলেন। আজিজুন বাইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে কোনো তথ্য সেভাবে মেলেনি। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল নাকি তাঁকে ইংরেজরা হত্যা করেছিল সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়নি।             
Blogger দ্বারা পরিচালিত.