CONSTITUTION DAY: ভারতর সংবিধানে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যা বলা হয়েছে
Odd বাংলা ডেস্ক: ভারতীয় সংবিধান তৈরির সময় বিশিষ্ট সংবিধান প্রণেতারা কোনো ধর্মীয় আঙ্গিকের থেকে ইতিহাস, যুক্তি এবং বাস্তবতা কেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
ভারতীয় সংবিধানে, ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (Secular State) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে । কোনো বিশেষ ধর্মকে ভারতের রাষ্ট্রীয়ধর্ম (State Religion) হিসেবে স্বীকার করা হয়নি । ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী জাতি, ধর্ম ও ভাষার পার্থক্যের জন্য রাষ্ট্র কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না । প্রত্যেক নাগরিকই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ করতে পারবে ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত ভারতীয় রাষ্ট্র তাঁর সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য কয়েকটি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছে এবং এই ছয়টি অধিকারের মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার হল অন্যতম।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতবর্ষকে নিজের পদানত রেখে শোষণ করার জন্য “Divide and Rule” পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। ফলে হিন্দু-মুসলমান, যাকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম “একই বৃন্তে দুটি কুসুম”হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় যার করুন পরিণতি হিসেবে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরী হয়, সেই সাথে দেশভাগের মর্মান্তিক স্মৃতিও মনের কোণে গেঁথে যায়, তাই উক্ত কথাগুলি মাথায় রেখেই ভারতের সংবিধানের প্রণেতারা অনেক বিচক্ষণতার সাথেই ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের তালিকায় সকল নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার কে মান্যতা দিয়েছিলেন যা এই নিম্নলিখিত ধারা গুলিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে উল্লেখ আছে -
২৫ নং ধারা- প্রত্যেক নাগরিককে তাদের নিজেদের বিবেক অনুযায়ী যে কোনও ধর্মমত গ্রহণ, ধর্মপালন ও নিজেদের ধর্মমত প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়ছে।
২৬নং ধারা- ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও তা রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে প্রতি ধর্মকে।
২৭ নং ধারা- ধর্মের ভিত্তিতে কর বসানোর প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২৮ নং ধারা- সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে সরকারি অর্থ দ্বারা পরিপোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আর যেহেতু ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পরে তাই যদি কোনো সরকার এর অন্যথা করে তাহলে সাধারণ মানুষ ধারা ৩২ যা সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার হিসাবে পরিচিত তার সাহায্যে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের (সুপ্রিম কোর্ট), এবং ধারা ২২৬ এর সাহায্যে রাজ্যের উচ্চ আদালতের (হাই কোর্ট) দ্বারস্থ হতে পারেন, কারণ আমাদের ভারতীয় সংবিধান এর অভিভাবক হলেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট।
“নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান” এর এই ধারাকে বজায় রেখে পরবর্তী কালে ১৯৭৬ সালে, ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি যুক্ত করা হয়।
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা-
আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম
সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়িয়া তুলিতে এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে:
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ;
চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা ;
প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতভাবে লাভ করেন;
এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভ্রাতৃভাব বর্ধিত হয়;
তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া আমাদের সংবিধান সভায় অদ্য, ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে, এতদ্দ্বারা, এই সংবিধান গ্রহণ, বিধিবদ্ধ এবং আমাদিগকে অর্পণ করিতেছি।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রাক্তন মুখ্য বিচারপতি মাননীয় শ্রী মহম্মদ হিদায়াতুল্লা সাহেবের মতে -
“Preamble resembles the Declaration of Independence of the United States of America, but is more than a declaration. It is the soul of our Constitution, which lays down the pattern of our political society. It contains a solemn resolve, which nothing but a revolution can alter.”[4]
আমাদের সংবিধানে উল্লেখ্য এই ধর্মনিরপেক্ষ তা কিন্তু প্রচলিত পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার থেকে অনেকাংশেই আলাদা, কেমন করে দেখি একটু -
যেমন ধরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা অনুযায়ী তাদের রাষ্ট্র যেকোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে পৃথক থাকে, কিন্তু আমাদের ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল ধর্ম কে সমান নজরে দেখে, একটির জন্য অন্যটিকে বৈষম্যের শিকার হতে হয় না। এবং তাই ভারত সরকার -
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের কে এতকাল তাঁদের পবিত্র হজ যাত্রার জন্য ভর্তুকি দিয়ে এসেছে
কখনো আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অমরনাথ বা মানস সরোবর তীর্থ যাত্রার জন্য ভর্তুকি দিয়ে এসেছে
আবার কখনো শিখ ধর্মাবলম্বীদের “লঙ্গার” প্রথা(মানে ক্ষুধার্ত কে খাওয়ানোর মত পবিত্র কাজ) কে জি এস টি বা ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্সের বাইরে রাখা হয়েছে
পার্সি জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে ভারত সরকার জিও পার্সি নামক প্রকল্পও চালু করেছে।
তবে একথাও ঠিক যে অন্য যেকোনো মৌলিক অধিকারের মতোই এই ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারও কখনই অবাধ নয়। মানে রাষ্ট্র জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, সদাচার, মানবতা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার কারণে বিধিনিষেধ আরোপ করতেই পারে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলাদের বিরুদ্ধে এতদিন ধরে হয়ে চলা তিন তালাক এর মত অমানবিক প্রথা বন্ধ করতে তৎপরতা দেখানো।
এইবার আপনি বলতেই পারেন যে এ আর এমন কি! পরবর্তীকালে কোনো সরকার চাইলেই তো সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এই “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি কে মুছে ফেলতে আর কতক্ষন?
কিন্তু এখানে আপনাকে বলে রাখি উপোরক্ত শব্দটি সংবিধানের পাতা থেকে মুছে ফেলা অত সহজ নয়, কারণ -
১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ বনাম কেরল রাজ্য মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাবনা কে সংবিধানের অন্যতম অংশ হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং ১৯৮০ সালে মিনার্ভা মিল মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাবনায় উল্লেখ্য “ধর্মনিরপেক্ষ” কে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম অংশ হিসাবে বর্ণিত করেন এবং সাথে এও বলা হয় যে পরবর্তীকালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বাকি অংশ বদলানো গেলেও মৌলিক কাঠামো কে কখনই বদলানো যাবে না।
Post a Comment