রাজা ত্রিশঙ্কু, যে আজও স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে ঝুলে আছে


Odd বাংলা ডেস্ক: ত্রিশঙ্কু ছিলেন সূর্য বংশের এক বিখ্যাত রাজা এবং ভগবান রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। একসময় তিনি সশরীরে স্বর্গে যাবার জন্য মনস্থির করেন। কূলগুরু বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে তিনি নিজের মনোবাসনা ব্যক্ত করে প্রয়োজনীয় যজ্ঞীয় বিধি আয়োজন করতে অনুরোধ করলেন। বশিষ্ঠ জানালেন, নশ্বর দেহ পরিত্যাগ না করে গোলোকে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধ। একাজ তিনি কোনোমতেই অনুমোদন করবেন না। গুরুদেবের কথায় নিরাস হয়ে তিনি দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন। দক্ষিণ প্রদেশে বশিষ্ঠের শতপুত্র কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন। তাদের কাছে গিয়ে ত্রিশঙ্কু বিনীত ভাবে একই অনুরোধ করলেন। বশিষ্ঠের পুত্রগন অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আমাদের পিতা যে কাজ করতে অসম্মত হয়েছেন, তাকে অতিক্রম করে সেই কাজ করার স্পর্ধা আমাদের নেই। আপনি গরু বাক্য অমান্য করেছেন, তাই আমাদের অভিশাপে আপনি চন্ডাল হয়ে যাবেন। বশিষ্ঠের পুত্রদের অভিশাপে সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক বিকট দর্শন চন্ডালে পরিনত হলেন। 

ত্রিশঙ্কুর বিকৃত রূপ দেখে আত্মীয় স্বজন, পাত্র মিত্র এবং মন্ত্রীরা একে একে সবাই তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। ব্যার্থ মনোরথে বনের পথ ধরে চলতে চলতে এক সময় তিনি ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বিশ্বামিত্র তাকে চিনতে পেরে তার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং তার চন্ডাল রূপ প্রাপ্তির কারন জানতে চাইলেন। ত্রিশঙ্কু রাজর্ষিকে প্রণাম করে একে একে সব ঘটনা বর্ণনা করেলেন। সব শুনে বিশ্বামিত্র বললেন মহারাজ আপনি আমার স্মরনাগত, তাই আমি আমার তপস্যা বলে আপনার সশরীরে স্বর্গলাভের প্রয়োজনীয় যাগযজ্ঞাদি করব। এই বলে তিনি সমস্ত শিষ্যদের ডেকে চতুর্দিকে যত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আছেন সবাইকে এই যজ্ঞে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ করতে পাঠালেন। বিশ্বামিত্রের তপের প্রভাব কারো অজানা নয়। তাই প্রায় সকলেই বিনা আপত্তিতে এই বিশেষ যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হলেন।

 কেবলমাত্র মহোদয় নামে এক ঋষি এবং বশিষ্ঠের শতপুত্র আসতে রাজি হলেন না। তারা ঘৃণা ভরে জানালেন, তারা চন্ডালের যজ্ঞীয় হবিঃ কোনমতেই গ্রহণ করবেন না এবং বিশ্বামিত্র নিজে ক্ষত্রিয় হয়ে কোন সাহসে এই দুঃসাধ্য কাজ করতে চাইছেন? শিষ্যেরা ফিরে এসে গুরুদেবকে একথা জানানে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমি এক কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান করছি, কোনো প্রকার দোষ এখনো আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। এসব জেনেও বশিষ্ঠের পুত্রগন আমাকে দোষারোপ করছেন! আমার অভিশাপে তারা সাতশত জন্ম পর্যন্ত শববস্ত্র আহরন করে এবং কুকুরের মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করবে। আর নির্বোধ মহোদয়ও আমাকে অকারণে দোষ দিচ্ছেন, তাই তাকেও চন্ডাল হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরতে হবে। এই বলে তিনি মৌন হয়ে রইলেন। এদিকে ঋষিগন বিশ্বামিত্রের এই উগ্র রূপ দেখে দ্রুততার সাথে যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। শুরু হল এক নরদেহ ধারীকে সশরীরে স্বর্গে পাঠানোর এক অভূতপূর্ব যজ্ঞ। প্রধান পুরোহিত রূপে বসলেন বিশ্বামিত্র স্বয়ং। দীর্ঘ ও জটিল যজ্ঞ সম্পন্ন করে নিজের তপের প্রভাবে বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গের দিকে তুলে দিলেন। কিন্তু স্বর্গ দ্বারে পৌঁছতেই দেবরাজ ইন্দ্র সহ অন্যান্য দেবগন তাকে বাধা দিলেন। দেবরাজ বললেন, তুমি গুরুবাক্য লঙ্ঘন করে অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ লাভের অধিকার হারিয়েছ। এক্ষুনি তুমি অধঃমুখে পৃথিবীতে পতিত হও। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দ্রুত গতিতে মাথা নিচের দিকে করে পৃথিবীতে পড়তে লাগলেন। 

এমতাবস্থায় ভীত ত্রিশঙ্কু বিশ্বামিত্রকে  স্মরন করলে তিনি তার সমস্ত ত্যেজ একত্রিত করে তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন এবং ইন্দ্রের ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে মহাকাশেই ত্রিশঙ্কুর জন্য দ্বিতীয় আরেকটি স্বর্গ নির্মান করে দিলেন। এরপর সেখানেও প্রথম স্বর্গের মতো অবিকল সব কিছু তৈরি করে ত্রিশঙ্কুকে ইন্দ্রের সমতুল্য শক্তি প্রদান করার জন্য মনস্থির করলেন। বিশ্বামিত্রের এই কার্যকলাপ দেখে ইন্দ্রাদি দেবগন ভীত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে তার স্তুতি করতে লাগলেন। এবং বললেন ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গ এবং ইন্দ্রের সমতুল্য শক্তি প্রদান করলে সে স্বর্গরাজ্যও দখল করে নিতে পারে। এতে দেবতাদের অস্তিত্বের শঙ্কট দেখা দেবে। 

বিশ্বামিত্র বললেন, আমি ত্রিশঙ্কুকে কথা দিয়েছি যে তাকে স্বর্গে প্রেরণ করব, আমি আমার কথার খেলাপ করতে পারব না। তখন দেবতাগন বললেন, তবে তাই হোক। ত্রিশঙ্কু তার নিজের স্বর্গে স্বমহিমায় অবস্থান করুক, তার গতিবিধি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাক। কিন্তু তাকে মাথা নিচের দিক করেই থাকতে হবে। বিশ্বামিত্র এতে সম্মত হলেন। সেই থেকেই ত্রিশঙ্কু সপ্তর্ষিমন্ডলের পাশে নিজের স্বর্গে অধমুন্ডে ঝুলে আছেন।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.