শুধু পাখি নয়, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ মৃত্যু হচ্ছে মানুষেরও, লুপ্তপ্রায় ইনুইটরা


Odd বাংলা ডেস্ক: আলাস্কা, গ্রীনল্যান্ড, সাইবেরিয়া আর কানাডার পূর্বাংশে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই ইনুইটদের দেখা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে ‘এস্কিমো’ নামেই এরা পরিচিত। তবে ‘এস্কিমো’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘কাঁচা মাংসখেকো’ হওয়ায় অনেকের মতেই এই নামটি এড়িয়ে যাওয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করেই রহিত করে দেওয়া হয়েছে ‘এস্কিমো’ শব্দটি। মেরু অঞ্চলের সাদা তুষারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলো নিজেদেরকে ‘ইনুইট’ বা ‘মানুষ’ নামে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেশ এদেরও ছুঁয়ে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে একদিকে যেমন মেরুর বরফ গলছে, সাথে এই ইনুইটদের জীবনধারাও বদলে যাচ্ছে। একটু আগেই যে বরফের হাইওয়ের কথা বলা হচ্ছিলো সেগুলো দিনে দিনে নড়বড়ে আর ভঙ্গুর হয়ে উঠছে, মেরু ভালুক সহ বরফের সাথে মিতালি করে বেঁচে থাকা এসব প্রাণীদের উপর সৃষ্টি হচ্ছে চাপ।

৬১ বছর বয়সী এক ইনুইট গবেষক ডেরিক পোটল নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছিলেন, তুষারের কঠিন আর রুক্ষতাকে ভালোবাসা এসব ইনুইটদের জন্য জীবন কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি বছরই কোনো না কোনো তুষারঝড় পাড়ি দিয়েছেন, স্লেজ টানা গাড়ির পথ পড়ি দিয়ে স্নো-মোবাইলের যুগটাও বেশ উপভোগ করছেন। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সাতটি মরু ভালুক শিকার করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন রিগোলেট সহ আশপাশের বিস্তৃত এলাকা।

চার দশক আগেও যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারতেন ইনুইটরা সেখানে ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে ফাটল, জায়গায় জায়গায় কমছে বরফের পুরুত্ব। স্নো-মোবাইল কিংবা স্লেজ টানা গাড়ি দিয়ে যাতায়াত হয়ে উঠছে অনেকটাই বিপজ্জনক। ডেনরিকের মতে, তার জীবদ্দশাতেই রিগোলেট এবং আশাপাশের এলাকার বরফের পুরুত্ব কম করে হলেও চল্লিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

নিউফাউন্ডল্যান্ড মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষকদল সম্প্রতি বরফের পুরুত্ব কমে যাওয়ার ফলে ইনুইট এবং এই এলাকার প্রাণীবৈচিত্র্যের উপর সৃষ্ট প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই এলাকায় অনেক বেশী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি মেরুর বরফ গলে যাওয়ায় তৈরী হচ্ছে ‘Arctic amplification’। এটি মূলত একটি দুষ্টচক্রের মত কাজ করে। যেমন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরুর বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির পরিমাণ বাড়ছে। শ্বেতশুভ্র বরফ সমপরিমাণ পানির তুলনায় অনেক কম তাপ গ্রহণ করে। বরফের রঙ সাদা হওয়ার কারণেই এটি সুর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে দেয়। এর তুলনায় পানি অনেক বেশী তাপ গ্রহণ করে। ফলে সমুদ্রের পানিতে অনেক বেশী তাপ বন্দি হয়ে থাকে, যা আবার পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং মেরুর বরফ গলনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। এভাবেই ‘Arctic amplification’ এর দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেয়ে মেরু এলাকার বরফের পুরুত্ব কমছে প্রতি বছর। আর দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করে আসা এই ইনুইটরা নিজ ভূমেই পরবাসী হয়ে পড়েছেন।

সমস্যা সমাধান এবং ইনুইটদের পুনর্বাসনের একটি সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতে বেশ কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা কানাডার রিগোলেট এলাকার অধিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে খাদের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে এই মানবগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হচ্ছে বলেই এসব গবেষণা থেকে উঠে এসেছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার প্রাণিজ প্রোটিনে আর চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্যে অভ্যস্ত এই জনগোষ্ঠী দ্রুত তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। তাতে একদিকে যেমন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, পাশাপাশি তারা শিকার হচ্ছেন নানা মানসিক প্রতিবন্ধকতার। এমনকি কানাডার রিগোলেট এলাকায় বসবাসরত ইনুইট জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ। আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কানাডিয়ান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, কানাডায় বসবাসরত ইনুইট জনগোষ্ঠীর তরুণদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। উচ্চ আত্মহত্যার এই প্রবণতার পেছনে পরিবেশগত কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকেই দায়ী করছেন অনেকেই।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.