পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক রেল দুর্ঘটনা


Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নিরাপদ আর স্বস্তির ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে অনেকেই বেছে নেন ট্রেনকে। কিন্তু তবে কখনো কখনো ট্রেনেও ঘটে যায় ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। লাইনচ্যুত হয়ে বা মুখোমুখি সংঘর্ষে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। বাংলাদেশে আজ যেমন দুটো ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন মানুষ প্রাণ হারিয়াছে, বিশ্বজুড়েও নানা সময়ে ঘটেছে বেশকিছু প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা। ভয়াবহ কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনার কথাই এখানে তুলে ধরা হলো-

বিহারের ট্রেন দুর্ঘটনা (নিহত প্রায় ৮০০)

দিনটি ছিল ১৯৮১ সালের ৬ জুন। এক হাজারেরও বেশি লোক নিয়ে ভারতের বিহারের বাঘমতি নদীর ওপর উঠতে যাচ্ছিল ট্রেনটি। গতি ছিল ঘন্টায় ৪০০ কিলোমিটার। আর সেই সঙ্গে ছিল বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া। বাঘমতি ব্রিজে ওঠার সময়ই চালক দেখতে পান সামনে দিয়ে পার হচ্ছে একটি গরু। চালক চেয়েছিলেন গরুটিকে আঘাত না করতে। কিন্তু হঠাৎ করা সেই ব্রেক সামাল দিতে না পেরে পুরো ট্রেনটিই রেললাইন থেকে নিচে পড়ে যায়। মোট ৭টি বগি পড়ে যায় নদীতে আর খানিকটা ঝুলে থাকে। একটি গরুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারায় আটশোরও বেশি মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাব মতে, নিহতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। কারণ এই ঘটনার পর অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর ট্রেনটিতেও ছিল অতিরিক্ত অনেক যাত্রী তাই তাদের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মধ্যেই ভয়ংকরতম রেল দুর্ঘটনা বলা হয় এটিকে।

ফ্রান্সের সেইন্ট-মিচেল-ডি-মারিয়েন দুর্ঘটনা (নিহত প্রায় ৭০০)

১৯১৭ সালের ১২ ডিসেম্বরের রাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালিয়ান ফ্রন্টে লড়াই করা হাজারখানেক সৈন্য ট্রেনে করে ফ্রান্সে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিন লড়াই করে সৈন্যরা ক্লান্ত থাকলেও, তাদের মধ্যে ছিল বাড়ি ফেরার উন্মাদনা। ইঞ্জিনস্বল্পতার জন্য সেদিন দুটি ট্রেনের বগি একটি ইঞ্জিনের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। মন্ট ক্যানিস টানেল পাড়ি দিয়ে ট্রেনটি যখন মডেন স্টেশনে পৌঁছাল, তখন এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আরও দুটি বগি। সব মিলিয়ে ট্রেনের বগির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯টি। ট্রেনটির পরবর্তী গন্তব্য চেম্বারি স্টেশন। ওই স্টেশন থেকেই সৈন্যরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতো।

১৯ বগির ট্রেনটি প্রায় সাড়ে তিন শ মিটার দীর্ঘ ছিল। লোহার তৈরি চেসিসের ওপর কাঠের অবকাঠামোযুক্ত বগিগুলো এবং ইঞ্জিনের সম্মিলিত ওজন দাঁড়িয়েছিল ৫২৬ টন। রাত সোয়া ১১টায় মডেন স্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের গতি হঠাৎ বাড়িয়ে দেয় চালক। ঘণ্টায় প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার বেগে চালাতে শুরু করেন তিনি। ওই ট্রেনের জন্য এটি ছিল অস্বাভাবিক গতি। কারণ যে এলাকা দিয়ে ট্রেনটি যাচ্ছিল, সেখানকার সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারিত ছিল ঘন্টায় মাত্র ৪০ কিলোমিটার। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। একটি লৌহনির্মিত সেতু পাড়ি দেওয়ার সময় বগিগুলো লাইনচ্যুত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে গেল। একেকটি বগি একটির ওপর অন্যটি গিয়ে আছড়ে পড়তে শুরু করল। ট্রেনে সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদও ছিল। ফলে আগুন লেগে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে সেগুলো। ট্রেনের চালক এতটাই বেখেয়ালি ছিলেন যে, দু-একটি বগি নিয়ে তিনি যখন পরবর্তী স্টেশনে গিয়ে থামেন তখন পর্যন্ত তিনি জানতেনই না তার পেছনের বগিগুলোর লাইনচ্যুত হওয়ার খবর। শিগগিরই তিনি দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার উদ্দেশে মারিয়ান স্টেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে রওনা হন। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় ৭০০ সৈন্যের প্রাণহানি হয়ে যায়।

মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা দুর্ঘটনা (নিহত প্রায় ৬০০)

১৯১৫ সালের ২২ জানুয়ারি মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা নামক জায়গায় ঘটে এই দুর্ঘটনা। আর এতে নিহত হয় অন্তত ৬০০ মানুষ। ব্রেক ফেল থেকেই ঘটেছিল এই দুর্ঘটনা। অনেকে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়েও পড়েছিল। এতে হতাহতের পরিমাণ আরও বেড়ে গিয়েছিল।

রুমানিয়ার চূড়া স্টেশন দুর্ঘটনা (নিহত প্রায় ৬০০)

এই দুর্ঘটনাটিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ১৯১৭ সালের। ওই যুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল রুমানিয়া। দেশটির চূড়া নামের রেলস্টেশনের কাছে ঘটে এই দুর্ঘটনা। ট্রেনের যাত্রী ছিল ১০০০ জন। আর তারা সবাই ছিল আহত সৈনিক। রেলস্টেশনের জায়গাটি উঁচু থেকে নিচের দিকে ঢালু ছিল। আর রেললাইনটিও ছিল ক্ষতিগ্রস্ত। উঁচু থেকে নিচে ট্রেনচালক তার সহকারীরা নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। কাজ করেনি ট্রেনের ব্রেক। নামতে গিয়ে একটি বগির ওপর আরেকটি বগি উঠে দুমড়ে মুচড়ে যায়। এমনভাবে ট্রেনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে সেখান থেকে নিহতদের বের করাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। নিহতদের ঠিক মতো শনাক্তই করা যায়নি। কারও হাত, কারও পা, কারও মাথা কিংবা কারও দেহ পুরোটাই খন্ডিত হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্ঘটনার পর ট্রেনে আগুনও লেগে গিয়েছিল এতে করে নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। সরকারি হিসাব মতে নিহত হয় প্রায় ৬০০ লোক। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি।

রাশিয়ার উফা রেল দুর্ঘটনা (নিহত প্রায় ৫৭৫)

১৯৮৯ সালে জুনের ৪ তারিখ রাশিয়ার উফা শহরে ঘটে এই দুর্ঘটনা। দুই দিক থেকে দুইটি ট্রেন একে অপরকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। ট্রেন দুটোতে যাত্রী ছিল ১৩ থেকে ১৪শ। আর তাদের মধ্যে ছিল অনেক শিশুও। ট্রেন লাইনের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস পাইপলাইন। হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল সেই লাইনে গ্যাসের চাপ। আর তার ফলে লাইনটি লিক হয়ে গ্যাস বেরিয়ে পড়ল। ওপর দিয়ে যাচ্ছিল ট্রেন। ঘর্ষণের ফলে লেগে গেল আগুন। আর সেই আগুন এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে ছড়িয়ে পড়ল। গ্যাস লাইন আর দুটো ট্রেন মিলে এত ভয়ংকর এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল যেটার ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূর থেকে। ঘটনাস্থল ও পরে হাসপাতাল মিলে মারা গিয়েছিল প্রায় ৬০০ মানুষ।  পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছিল অনেককে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.