এক সময় মাদার টেরেসাও প্রচার করেছেন, "হস্তমৈথুন মহাপাপ"
Odd বাংলা ডেস্ক: নানান প্রাচীন সভ্যতায় হস্তমৈথুনের দিব্যি চল থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিক থেকে বিভিন্ন দেশে শুরু হয় এর প্রবল বিরোধিতা। হঠাৎ করে শুরু হয় বললে ভুল হবে। গোঁড়া ধার্মিকরা বহুদিন থেকেই এই অভ্যাসকে "পাপ" আখ্যা দিয়ে মানুষকে ভয় দেখিয়ে আসছেন। ইসলাম, খ্রীষ্টান, ইহুদী সব ধর্মের ধর্মগুরুরাই এর বিরোধিতা করেছেন, সে তাঁদের মূল ধর্মগ্রন্থে স্পেসিফিকালি একে পাপ বলে উল্লেখ থাক বা না থাক। আসলে সন্তান ধারনের প্রয়োজন ছাড়াও স্রেফ দৈহিক সুখলাভের জন্য যৌনতা – এই ব্যাপারটাই সব ধর্মের না-পসন্দ। "প্রোক্রিয়েশন" এর বাণী আউড়ে খ্রীষ্টান ক্যাথলিক চার্চ গুলো অন্য যে কোনো ধরণের যৌনতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। শুধু হস্তমৈথুন নয়, তার মধ্যে রয়েছে সমকামিতা, ওরাল বা অ্যানাল সেক্স, এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্য কন্ডোম জাতীয় ব্যারিয়ারের ব্যবহারও। এমনকি মাদার টেরেসার মত ব্যক্তিত্বও এই ধরণের প্রচার করে গেছেন! এক সময় চার্চ এমনও বলেছে যে ধর্ষণের চেয়েও হস্তমৈথুন বড় পাপ। কেন? না ধর্ষণে তো তাও "প্রোক্রিয়েশন" অর্থাৎ নতুন শিশুর জন্মের সম্ভাবনা থাকে, হস্তমৈথুনে সেটাও নেই!! আমেরিকার কিছু অঞ্চলে হস্তমৈথুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডও ঘোষণা করা হয়েছিল!
ইহুদীরাও এই ধরণের তত্ত্বে বিশ্বাস করত। তাই যে ধরণের যৌনতায় সন্তানলাভের সম্ভাবনা নেই তাকে পাপ হিসেবে ঘোষণা করেছিল তারা। বিশেষ করে "পুল আউট" পদ্ধতি, অর্থাৎ সঙ্গমের সময় যোনির বাইরে বীর্যপাতের মাধ্যমে কন্ট্রাসেপশন অভ্যাস করলেও সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হত। গোঁড়া ধার্মিকরা তো ছিলেনই, অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় শুরু হল ডাক্তারদের তরফে হস্তমৈথুনের বিরোধিতা। সুইস ডাক্তার স্যামুয়েল টিসোর লেখা বিখ্যাত বই "ওনানিসম" এ ব্যাখ্যা করা হয় যে হস্তমৈথুন করলে গেঁটে বাত এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা থেকে শুরু করে নার্ভাস সিস্টেমের চরম ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আরও বিভিন্ন হাতুড়ে ডাক্তার এই ধরণের প্রচার চালাতে থাকেন। ধর্মবিশ্বাসীরা তো আগেই পাপের ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন, এখন অন্যান্যরাও ভয় পেতে শুরু করলেন। এই ভয় ছড়িয়ে গেল সারা বিশ্বেই। মার্ক টোয়েনের মত ব্যক্তিত্বও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছিলেন "When you feel a revolutionary uprising in your system, get your Vendome Column down some other way- don't jerk it down." অথচ সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলে মেয়েরা তো এত জানেনা। তারা হস্তমৈথুন করতে গিয়ে অনেক সময়ই ধরা পড়ে যায় বাবা মার কাছে। তারপর যা হয় সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বাবা মা রা সন্তানের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে এইসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া শুরু করলেন। এবং সেই ডাক্তাররা চিকিৎসা হিসেবে ছেলেদের লিঙ্গের ফোরস্কিন বিশ্রীভাবে কেটে দেওয়া বা মেয়েদের ক্লিটোরিস কেটে বাদ দেওয়া অথবা গরম ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, এই ধরণের আসুরিক চিকিৎসা করতে লাগলেন… যাতে ব্যাথার চোটে তারা হস্তমৈথুনে বিরত থাকে। এমন কি পুরুষাঙ্গ বা অণ্ডকোষ কেটে বাদ দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে খোদ আমেরিকার বুকে। যারা ধরা পড়ে গিয়ে এই ধরণের অত্যাচারের শিকার হত তাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, বাকি যারা লুকিয়ে স্বমেহন চালিয়ে গেল তাদের মনে জন্ম নিল অস্বাভাবিক ভয় এবং সেগুলো নিঃসন্দেহে তাদের মানসিকভাবে সমস্যায় ফেলতে লাগল।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকে অনেকদিন পর্যন্ত। এমনকি বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও আমেরিকার স্কুলপাঠ্য জীবনবিজ্ঞান বইয়ে হস্তমৈথুনকে একটা রোগ হিসেবে উল্লেখ করা ছিল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবে জীবাণুর ভূমিকা সম্পর্কে মানুষ যত অবগত হতে লাগল তত এই ধরণের ভুল ধারণা ভাঙতে শুরু করল। সিফিলিস, গনোরিয়ার মত যৌনরোগ যে আসলে জীবাণুর আক্রমণে হয় সেগুলো আবিষ্কার হওয়ার পর বোঝা গেল ওই অসুস্থতাগুলো তবে হস্তমৈথুনের কারণে হতনা। আর হবেই বা কিভাবে ভাবুন দেখি? সঙ্গমের সময় যেভাবে যৌনাঙ্গগুলি উত্তেজিত হয় সেটাকেই হাতের সাহায্যে সিমুলেট করা হচ্ছে, তা যদি ক্ষতিকর হত তবে তো যৌনমিলন ব্যাপারটাই ক্ষতিকর হত! ওদিকে কিনসের বিখ্যাত সার্ভে থেকে দেখা গেল প্রায় ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৭০ শতাংশ নারী এই অভ্যাসে অভ্যস্ত। এত বিপুল পরিমাণ লোক যখন দিব্যি স্বাভাবিক রয়েছেন তখন এটি যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর নয় সেটা বলাই বাহুল্য। বরং ধীরে ধীরে গবেষণায় দেখা যেতে লাগল হস্তমৈথুন খারাপ তো নয়ই, বরং এর অনেক ভাল গুণ আছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই যেকোন উপায়ে যৌন তৃপ্তির পাওয়ার সঙ্গেই যুক্ত। অর্থাৎ মন ভাল থাকা, স্ট্রেসমুক্ত থাকা থেকে শুরু করে পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমানোরও নিদর্শন পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে উপরি পাওনা হল এর মাধ্যমে এইডস বা অন্যান্য যৌন ব্যাধি ছড়াবার ভয় নেই, যা কিনা অনেক অপরিণত ছেলেমেয়ে আনসেফ সেক্স এর মাধ্যমে বাধিয়ে বসে। তাই আজকালকার ডাক্তাররা এতে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, বরং উৎসাহ দেন। কেবল সিঙ্গল নর-নারীর জন্যেই নয়, কাপলদের জন্যও একক বা যৌথ হস্তমৈথুন সময় বিশেষে উপযোগী বলা হয়। এও দেখা গেছে যাঁরা আগে থেকে হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত, সেরকম কাপলদের মধ্যে সেক্সুয়াল কম্যুনিকেশন অনেক ভাল হয়। আপনি কিভাবে সবচেয়ে বেশি অ্যারাউজড হন সেইটে নিজে ভাল ভাবে বুঝলে তবেই না সেটা আপনার পার্টনারকে বলতে পারবেন? আফটার অল, কবি তো বলেইছেন – "আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবেনা/ এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা…"। তাই আধুনিক যৌনবিজ্ঞান বলছে "হস্তমৈথুন কেবল লুজার-রা করে (অর্থাৎ যারা সেক্স পার্টনার জোটাতে পারেনা তারা)" এই প্রাচীন ধারণাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে।
কিন্তু তবু সমাজ কি সেটা মেনে নিয়েছে? পশ্চিমে কিছুটা মেনে নিলেও ভারতে তো একেবারেই না। সবাই জানে যে বেশিরভাগ মানুষই হস্তমৈথুন করে থাকেন, বা অন্তত কখনো করেছেন। তবু একে ঘিরে এক অদ্ভুত লুকোছাপা। সেক্স এডুকেশন ব্যাপারটাই এখনও গৃহীত নয় সেভাবে। সুতরাং এ আর আশ্চর্য কি? সভ্য সমাজে এই শব্দটি উচ্চারণ করাটাই অশ্লীলতা বলে মনে করেন অনেকে। অনেকে যুক্তি দেবেন এটা তো একটা খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ নিয়ে আলোচনা করতে যাব কেন? যুক্তিটা ঠিক ধোপে টেকেনা। প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা এই সমস্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা আপনি কারো সাথে শেয়ার করবেন কিনা সে আপনার ইচ্ছে। তা বলে কেউ সে নিয়ে আলোচনা করলেই "ছি ছি" রব, বা হস্তমৈথুন নিয়ে রাখঢাকের মাধ্যমে সেই সংক্রান্ত কুসংস্কার গুলি জিইয়ে রাখা কি কাজের কথা? ভাবুন তো, আপনার সন্তান যদি এই ভয় নিয়ে স্বমেহন করে যে এর ফলে তার হাতের চেটোয় চুল গজাবে, বা মুখে ব্রন হবে, কিম্বা শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে, তাহলে তার মানসিক প্রভাবটা কি ভাল কিছু হবে? গবেষণায় দেখা গেছে টিনেজার দের মধ্যে হস্তমৈথুনের খারাপ প্রভাব সত্যি সত্যি হয়ে থাকে অনেক সময়, আর সেটা পুরোটাই এই ধরনের ভয় বা অপরাধবোধ থেকে জন্মানো। এই ধরনের একটি মানসিক সমস্যার কথা জানতে এই আর্টিকলটি পড়ে দেখতে পারেন। এরকম অপরাধবোধ না থাকলে কোনো ধরনের শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনাই নেই যদি না এটি নেশায় পরিণত হয়। যে কোনো ধরনের নেশা (এমন কি চায়ের নেশাও) বা কম্পালসিভ আচরণের মতই এই নেশাও মানসিক দিক থেকে ক্ষতিকর। তা না হলে হস্তমৈথুন যে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি কাজ, সেই গ্রহণযোগ্যতাটা সবার আগে আসা দরকার। সেই সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই আসবে সমাজে, শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে এই ব্যাপারে মুক্ত চিন্তা।
Post a Comment