সম্রাট আকবরের এই ছেলে বন্দুকের নলে মদ্যপান করে মারা গিয়েছিলেন


Odd বাংলা ডেস্ক: সম্রাট আকবর শুধু ভারতের নন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে অন্যতম। তবে জন্মের পর থেকেই তিনি অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করেছেন। দিল্লির সংহাসনে মির্জা হুমায়ুন আসীন হবার পর থেকে অনিশ্চয়তা কিছুটা কমেছিলো ঠিকই, তবে একেবারে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে আকবর দৃঢ় শক্তির মাধ্যমে প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলেন।

আকবরের পুত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ দানিয়েল। তিনি ১৫৭২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আজমীরে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ দানিয়েল নামের একজন সুফী সাধকের ঘরে জন্ম নেওয়ায় তার নামেই আকবরের এই পুত্রের নামকরণ করা হয়। আকবর তখন গুজরাটে রাজকীয় সংঘাত মোকাবেলা করছিলেন। নবজাত শিশুটি রাজপুত রাজা বীর ভারমলের রানীর হাতে কিছুদিন প্রতিপালিত হয়েছিলেন।

ইতিহাস বলে, শেখ দানিয়েল দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন। তার চলাফেরা ও অঙ্গভঙ্গিতে বেশ অভিজাত ভাব ফুটে উঠতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, দানিয়েল ভালো ঘোড়া ও হাতি বেশ পছন্দ করতেন। এমনকি ঘোড়া বা হাতির খবর পেলে তিনি উচ্চ মূল্য দিয়ে হলেও তা সংগ্রহ করতেন। এছাড়া হিন্দী লোকগীতি তার পছন্দের বিষয় ছিলো। তিনি মাঝে মাঝে যেসব কবিতা রচনা করতেন, তাতে হিন্দী ভাষায় সুন্দর শব্দ স্থান পেতো। আকবরের তিন পুত্রের মধ্যে দানিয়েল ছিলেন সবচেয়ে ছোট। স্বভাবের দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত খেয়ালী মনের। তার বিচিত্র খেয়ালের কারণে সাম্রাজ্য বিভিন্ন সময় বেশ ভুক্তভোগী হয়েছে।
দানিয়েলের সঙ্গে অন্য নারী যৌনাচারে ব্যস্ত

মুঘল সাম্রাজ্যে মনসবদারী প্রথা চালু হবার পর সম্রাটের তিন পুত্রকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। শেখ দানিয়েল এর আওতায় ৬,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী, একজন অভিভাবক এবং প্রশাসন চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থবল পেয়েছিলেন। ১৫৯৩ সালে সাম্রাজ্যের সংঘর্ষের কারণে আকবর দাক্ষিণাত্য অভিযানের আয়োজন করেন। তাতে শাহজাদাদেরও ডাক পড়ে। শেখ দানিয়েলের বয়স তখন ২২ বছর। আবদুর রহিম খানে খানান ও রাজা রায় সিং এর তত্ত্বাবধানে তাকে ৭০,০০০ সৈন্যের প্রধান করা হয়। তবে সেবার দানিয়েল নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

শাহজাদা দানিয়েল শিকার করতে খুব ভালোবাসতেন। আর এই কাজে বন্দুক শুধু তার সহায়কই ছিলো না, রীতিমতো বন্ধুর মতো প্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তার বেশ কিছু বন্দুকের মধ্যে একখানা তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছিলো। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘ইয়াকা-উ-ঘনাজা’। ফারসি এই শব্দের অর্থ ‘মৃতদেহের বাক্সের মতো’।

তুন প্রদেশের শাসনকর্তা হিসেবে দানিয়েল তেমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি। তার চেয়ে নিজের শখ ও আমোদ পূরণের সাধ আরো বেশি করে দেখা দিয়েছিলো। ফলে প্রশাসনে অব্যবস্থাপনা দেখা দিতে থাকে। আর তা শেষ অবধি সম্রাট আকবরের কানে যায়। শাসনভার নেওয়ার পরই যে কয়েকটা বাজে অভ্যাস শাহজাদা দানিয়েলকে একেবারে ঘিরে ধরেছিলো, তার মধ্যে একটি ছিলো অতিরিক্ত মদ্যপান। সমস্ত দিন রাত মদ্যপ থাকার ফলে শুধু প্রদেশের শাসনকাজ নয়, তার নিজের দৈহিক অবস্থাই ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যেতে লাগলো। ফলে বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য প্রদেশের অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রাজপুত্রের অতিরিক্ত মদ্যপানের খবর সম্রাট আকবরের কানে যথাসময়েই পৌঁছে গিয়েছিলো। আকবর রেগে গিয়ে খানে খানানকে তিরষ্কার করে একটি শাহী ফরমান পাঠান। তবে এক্ষেত্রে খানে খানানকে খুব বেশি দোষ দেওয়া চলে না। শাহজাদাকে মদের আসক্তি থেকে দূরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিন্তু তিনি আকবরের অভিভাবক বৈরাম বেগের মতো প্রয়োজনে কঠোর হতে পারতেন না। এই কারণে তার বাঁধা সত্ত্বেও দানিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর তার মূল্য দিতে হয়েছিলো প্রদেশের প্রশাসনকে। শেষে অন্য কোনো উপায় না থাকায় সম্রাট আকবরের নির্দেশে কিছু কঠোর আদেশ জারি করা হলো। শাহজাদা দানিয়েলের মদ পানের উপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। তার কাছে মদ পৌঁছানোর সম্ভাব্য সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। এমনকি শাহজাদার খাস চাকররাও নজরদারি থেকে বাইরে থাকলো না। রাজধানী থেকে আসা সম্রাটের বিশ্বস্ত গুপ্তচররা সবদিকে কড়া নজর রাখতো।

দানিয়েল যেন মহাবিপদে পড়লেন। অসহায় ক্ষুধার্ত বাঘের হাত থেকে তার শিকারকে ছিনিয়ে নিলে যে অবস্থা হয়, তারও একই অবস্থা হলো। তিনি সম্রাটের নির্দয়তাকে রীতিমতো অভিশাপ দিতে লাগলেন! আর কোনো উপায় না দেখে তিনি সবাইকে কাতরভাবে অনুনয় করে সামান্য মদ দিতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সম্রাটের কঠোর আদেশ একেবারে অকাট্যভাবে পালিত হচ্ছিলো। নেশার ঘোরে আকুলভাবে কাঁদতে থাকলেও তার আবেদন পূরণ করার কোনো উপায় ছিলো না। তবে বিকল্প এক উপায় শাহজাদা বের করেছিলেন। কিন্তু সেই বিকল্প উপায়ই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। দানিয়েলের প্রিয় অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুর্শিদকুলি খান (বাংলার সুবাদার মুর্শিদকুলি খান নন)। প্রতিকূল পরিবেশ বুঝেও তিনি সবসময় চাইতেন শাহজাদাকে সাহায্য করতে। তবে তার মদপানকে মুর্শিদকুলিও পছন্দ করতেন না। দানিয়েল তার কাছে শেষবারের মতো সামান্য মদ চাইলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, এরপর আর কখনও তা ছুঁয়ে দেখবেন না। চারিদিকে কড়া পাহারা থাকায় শাহজাদা তাকে প্রিয় বন্দুক ‘ইয়াকা-উ-ঘনাজা’ এর নলে করে যতটুকু সম্ভব ততটুকু মদ এনে দিতে বললেন। অনুগত মুর্শিদকুলি খান আদেশ মাথা পেতে নিলেন। বন্দুকের নল থেকে বহুদিনের পুরনো বারুদ ফেলে দিয়ে তার মধ্যে মদ ভরে শাহজাদার জন্য নিয়ে এলেন। তবে লোহার মরিচা আর বারুদ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়নি। সেগুলো মদে মিশে গিয়ে বিষাক্ত করে তুলেছিলো। সেই মদ হাতে পেয়েই শাহজাদা যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলেন। অনেক অতৃপ্ত পিপাসা মেটাতে সেই বিষাক্ত মদ তিনি পান করলেন। প্রতিক্রিয়া কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো। মদ পান শেষ হতেই শাহজাদা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে অসুস্থতা তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেলো। হতভাগ্য শাহজাদা চিরতরে অচল হয়ে পড়লেন।


Blogger দ্বারা পরিচালিত.