ভাবা যায়! কম্পিউটার তৈরির ১০০ বছর আগেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং লিখেছিলেন এই ব্যক্তি


Odd বাংলা ডেস্ক: মেয়েকে না জানি আবার এই কাব্য-কবিতার ভূতে পেয়ে বসে! তাই শুরু থেকে মেয়েকে তিনি দিয়েছিলেন গণিত আর সঙ্গীতের দীক্ষা। আর তাতেই কাজ হলো! ইতিহাসের অন্যতম সেরা কবির ঘরে আমরা খুঁজে পেলাম ইতিহাসের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামারকে। হ্যাঁ, আডা লাভলেস যে ইতিহাসের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার তা তো সাধারণ জ্ঞানের অন্তত প্রাথমিক পাঠ নেয়া সবাই-ই মোটামুটি জানে। ব্যাপারটা কিন্তু তারপরেও বিস্ময়কর, কম্পিউটার আবিষ্কারের এক শতাব্দী আগে কীভাবে একজন প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেললেন!

আসলে ১৮৪০ এর দশকেই আডা লাভলেসের কল্পনায় সংখ্যাকে সংকেতে কিংবা সংকেতকে সংখ্যায় রুপান্তরিত করার যন্ত্র চলে এসেছিল। সে গল্প বেশ লম্বা। তবে তাঁর প্রথম প্রোগ্রামার হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকলেও, সময় থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা একজন অসম্ভব প্রতিভাধর গণিতবিদ হিসেবে তাঁর প্রভাবকে কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।

লর্ড বায়রনের অবশ্য তাঁর মেয়ের এতসব কীর্তি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মেয়ের বয়স যখন নয়, তখনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কালজয়ী কবি। তাঁদের এই নয় বছরের গল্পও তেমন একটা সুখকর নয়। লর্ড বায়রন চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান হবে এক “ঐশ্বর্যময় পুত্র”, তাই কন্যার চেহারা দেখার পর তিনি হয়ে গেলেন হতাশ। আডার মা অ্যানাবেলা এক মাসের মাথায় মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন নিজের বাবার বাড়িতে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, লর্ড বায়রন এরপরও তাঁর কন্যার খোঁজখবর নেবার তেমন একটা চেষ্টা করেননি। দাম্পত্য জীবন বেশ কলহপূর্ণ ছিল দু’জনের। অ্যানাবেলা বায়রনের দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবনযাপন পছন্দ করতেন না। কন্যাকে তাই ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে গণিত আর যুক্তির সান্নিধ্যে বড় করলেন তিনি। ১৮১৫ এর ডিসেম্বরের ১০ তারিখে জন্ম আডা লাভলেসের, তাঁর বাবার মৃত্যু ১৮২৪ সালে। তবে আডা তাঁর বাবার চেহারা তাঁদের ফ্যামিলি পোর্ট্রেটে প্রথম দেখেন তাঁর ২০তম জন্মদিনে, এর আগে অ্যানাবেলা সেই ছবি ঢেকে রেখেছিলেন একটি সবুজ কাপড় দিয়ে।

১৮৩৩ সালে তরুণী আডার সাথে পরিচয় হয় ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্স প্রফেসর চার্লস ব্যাবেজের। হ্যাঁ, “কম্পিউটারের জনক” চার্লস ব্যাবেজ। আডার বয়স ছিল ১৭ তখন। আর ব্যাবেজের ৪২। কিন্তু দু’জনের পারস্পারিক বোঝাপড়াটা বেশ ভালোই হয়েছিল বুদ্ধিগত দিক দিয়ে।এর মধ্যেই আডার সাথে পরিচয় হলো উইলিয়াম কিং-নোয়েলের। এই সম্মানিত কাউন্ট অফ লাভলেসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন তিনি, তখন ১৮৩৫ সাল। অবশ্য উইলিয়াম কাউন্ট অফ লাভলেস হয়েছিলেন ১৮৩৮-এ। আডাও তখন হয়ে গেলেন “কাউন্টেস অফ লাভলেস।” অভিজাত নারী হিসেবে তাঁকে নিতে হলো বাধ্যগত স্ত্রী এবং দায়িত্ববান মায়ের ভূমিকা। তবে পরবর্তী দুই দশকে ব্যাবেজের সাথে মত বিনিময় এবং কাজকর্ম তিনি কখনোই থামাননি।

ব্যাবেজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন ছিল অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন। এ লোহালক্কড়ের তৈরি বাষ্পচালিত যন্ত্রটির পরিকল্পনা তিনি প্রথম করেন ১৮৩৭-এ। তাঁর পরিকল্পনায় যন্ত্রটির ছিল একটা সেন্ট্রাল প্রোসেসিং ইউনিট, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন “মিল”, আর ছিল এক্সপান্ডেবল মেমোরি, যার নাম দিয়েছিলেন “স্টোর।” পাঞ্চ কার্ড দিয়ে ডাটা ইনপুট দিলে তাঁর যন্ত্রটি বিভিন্ন গাণিতিক অপারেশন করে দিতে পারবে ডাটাগুলোকে নিয়ে- এটাই ছিল তাঁর মূল অভিপ্রায়।

ব্যাবেজের এই নকশাটির লিখিত রূপ দিয়েছিলেন ইতালীয় একজন গণিতবিদ। ব্যাবেজ ১৯৪৩ সালে আডা লাভলেসকে বলেন সেই বিবরণটি ইতালীয় ভাষা থেকে অনুবাদ করে দিতে। লাভলেস পরবর্তী নয় মাসে সেই কাজ তো করেনই, নিজেও ইচ্ছামত সাইডনোট যুক্ত করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত দেখা যায় আসল লেখা থেকে তাঁর অনুবাদ হয়ে গেছে তিনগুণ বড়! সেখানে ব্যাবেজের করা হিসাব-কিতাবগুলো সবই ছিলোই, সেগুলোর সব ভুলগুলোও তিনি শুধরে দিয়েছিলেন। এবং তাঁর সাথে যোগ হয়েছিল আডার নিজস্ব অনেক হিসাব-কিতাব। তিনি দেখালেন কীভাবে এই যন্ত্র দিয়েই সিক্রেট কোড উদ্ধার করা সম্ভব, বার্নোলির নাম্বারের সিকোয়েন্স বের করা সম্ভব। এগুলো দেখাতে গিয়ে তিনি কিছু ডায়াগ্রাম আঁকলেন, যেখানে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনগুলোর গুনতির পদ্ধতিগুলো দেখানো। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তাঁর ডায়াগ্রামগুলো হয়ে গেল পুরো এখনকার কম্পিউটার অ্যালগোরিদমগুলোর মত, হুবহু!

তিনি বললেন, একসময় তাঁদের এই যন্ত্রটা শুধু নাম্বার নিয়ে না সবকিছু নিয়েই অপারেশন করতে পারবে, শুধু তাদেরকে দিতে হবে কিছু “ফিক্সড সেট অফ রুলস।” এই যন্ত্র ব্যবহারিক বা বৈজ্ঞানিক সব ক্ষেত্রেই ব্যবহার্য হবে, বললেন অদ্ভুত রকম জটিল এবং সুন্দর সুরের সৃষ্টি করা যাবে এই যন্ত্র দিয়েই। প্রায় দু’শ বছর পরে এসে কম্পিউটার দিয়ে আমরা তাই-ই কিন্তু করছি! এই অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন অবশ্য কখনো তৈরি হয়নি, কিন্তু তাঁর সেই পাবলিকেশনটাই ব্রিটিশ সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে সারা ফেলে দেয়। মাইকেল ফ্যারাডে তো রীতিমত তাঁর ফ্যান বনে যান!

১৮৫২ তে ৩৬ বছর বয়সে লাভলেস মারা যান ক্যান্সারে। এর ১০১ বছর পরে তাঁর লেখাগুলো আবার প্রকাশিত হয়- এবং সেখান থেকেই নেয়া হয় আধুনিক কম্পিউটার তৈরির অনেক আইডিয়া। কতটাই না দূরদর্শী ছিলেন এই কিংবদন্তি নারী, দূরদর্শী না বলে বলতে হয়- দৈবজ্ঞ!

এই অসম্ভব প্রতিভাধর নারী লাভলেস নিজেকে বলতেন বিশ্লেষক আর দার্শনিক। তবে চার্লস ব্যাবেজই বোধহয় তাঁর সঠিক নামটা দিয়েছিলেন- “এঞ্চান্ট্রেস অফ নাম্বার্স”, বাংলায় বললে “সংখ্যার জাদুকরী।” উনবিংশ শতকের এক নারী কম্পিউটার আবিষ্কারের এক শতাব্দী আগে শুধু একটা কাগজ আর কলম হাতে লিখে ফেলেছেন কম্পিউটার প্রোগ্রাম, জাদু নয় তো কি!
Blogger দ্বারা পরিচালিত.