আগেকার দিনে তো প্রেগনেন্সি কিট ছিল না, তাহলে কেউ গর্ভবতী কি না তা জানা যেত কীভাবে?


Odd বাংলা ডেস্ক: আগেকার দিনে একজন নারী গর্ভবতী কিনা তা নিশ্চিত হতে প্রকৃতির উপরেই নির্ভর করতে হত, যা কিনা ছিল অনেকটা Wait and See এর মত। তবে মানবসভ্যতা কখনোই প্রকৃতির উপরে ভরসা করে চলেনি, বরং মানুষের নিজের মত করে প্রকৃতি জয় করার চেষ্টা ছিল সবসময়ই। আর এরই প্রমাণ বিভিন্ন মানবসভ্যতায় ব্যবহৃত অদ্ভুত সব গর্ভনিশ্চিতকরণ পদ্ধতি। এর ভেতরে অনেকগুলি পরে বৈজ্ঞানিকভাবে সত্যও প্রমাণিত হয়েছে। তারমধ্যে ঐতিহাসিক কয়েকটি পরীক্ষার কথা চলুন জেনে আসা যাক।

১. গম আর বার্লি বলবে গর্ভবতী কি না!
যীশু খৃষ্টের জন্মেরও প্রায় ১৩০০ বছর আগে মিশরীয় মেয়েরা গর্ভবতী কিনা তা জানতে এক অদ্ভুত পদ্ধতি ব্যবহার করত। ঋতুস্রাব বন্ধ অথবা বিলম্ব হলে গর্ভধারণ নিশ্চিত করার জন্যে মেয়েরা দুইটি পাত্রে রাখা গম আর বার্লির বীজের উপরে মূত্রত্যাগ করত। কিছুদিন মূত্রত্যাগের পর সেই বীজ থেকে গাছ হয়েছে কিনা তা দেখা হত। বলা হয়ে থাকে যে, গমের বীজ থেকে চারা বের হলে অনাগত সন্তান মেয়ে আর বার্লির বীজ থেকে চারা বের হলে সেক্ষেত্রে ছেলে হবার সম্ভাবনা বেশি ধরা হত। আর কোন বীজ থেকেই যদি চারা বের না হত সেক্ষেত্রে সেই নারী গর্ভবতী না বলে ধারণা করা হত।

ছেলে কিংবা মেয়ে হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা না করা গেলেও বীজ থেকে চারা বের হওয়াটা যে গর্ভধারণের সাথে সম্পর্কিত তা আবিষ্কার হয়েছে ১৯৬৩ সালে। গর্ভবতী নারীর মূত্রে থাকা অত্যাধিক ইস্ট্রোজেন বীজ থেকে চারা হবার জন্যে সহায়ক- ইংল্যান্ডের একদল গবেষক এমনটাই মত দিয়েছেন। তারা আরো বলেন, এই পদ্ধতিতে  মিশরীয়রা ৭০% ক্ষেত্রেই নির্ভুল ফল পেয়ে থাকত।

২. পি ফর পিঁয়াজও!
গর্ভধারণ নিশ্চিতকরণে প্রাচীন মিশরীয়দের মত প্রাচীন গ্রীকেরাও পিছিয়ে ছিল না। গ্রীকদের বরাবরই হিউম্যান এনাটমিতে ভাল দখল ছিল। সেই এনাটমির উপর ভর করেই তারা মিশরীয়দের থেকেও অদ্ভুত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। পদ্ধতিটি ছিল এরকম, “কোন নারী যদি সন্দেহ করে সে গর্ভবতী, তবে তা নিশ্চিত হতে যেন সে ঘুমানোর আগে যোনীপথে পিঁয়াজ ঢুকিয়ে রাখে। যদি সকালে ঘুম থেকে উঠে তার মুখে পিঁয়াজের গন্ধ পাওয়া যায় তবে সে গর্ভবতী নয় আর যদি পাওয়া না যায় তবে সে গর্ভবতী।”

এইটার ব্যাখ্যা গ্রীকেরা দিয়েছিলেন এভাবে যে, “মুখ থেকে  যোনী পর্যন্ত পথখানা একটা টানেলের মত। এর মাঝখানে কিছু থাকলে অর্থাৎ গর্ভবতী হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে পিঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ মুখে পৌঁছুবে না, অন্যথায় পৌঁছুবে। অবশ্য ফাদার অব মেডিসিনখ্যাত গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস অন্য আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন।

হিপোক্রেটস বলেন,“কোন নারী গর্ভবতী কিনা তা নিশ্চিত হতে সে যেন রাত্রে ঘুমাতে যাবার আগে পানির সাথে অল্প মধু মিশিয়ে পান করে। গর্ভবতী হলে সেক্ষেত্রে সে তার পেট ফাঁপছে এমন বোধ করবে।”

৩. পিস প্রফেটস
ইউরোপে ১৬ শতকে একদল মানুষ নিজেদেরকে ‘পিস প্রফেটস’ (Piss Prophets) বলে পরিচয় দিত। তারা দাবী করত, মূত্র দেখেই তারা একজন নারী গর্ভবতী কিনা তা বলে দিতে পারে! তারা মূলত মূত্রের সাথে সামান্য মদ মিশিয়ে তা দেখে বলতে পারত গর্ভবতী কিনা।

পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- গর্ভবতীদের মূত্রে থাকা অধিক প্রোটিন মদের সাথে বিশেষ বিক্রিয়া করত, যা দেখে সে নারী গর্ভধারণ করেছে বলতে পারাটা আদৌ কঠিন কিছু ছিল না।

৪. চোখ দেখে যায় চেনা
১৬ শতাব্দীর প্রখ্যাত চক্ষুবিদ ডা. জ্যাকিস গিলিমে বলেন, নারীর চোখ দেখে সে গর্ভবতী কিনা তা বলে দেয়া সম্ভব। একজন সন্তানসম্ভবা নারীর চোখের পিউপিল বা তারারন্ধ্র স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট থাকবে এবং চোখের আশেপাশের শিরাগুলিও সুস্পষ্ট হবে- এমনটাই দাবি করেন তিনি।

তার এই ব্যাখ্যার অবশ্য বিপক্ষে মতই বেশি পাওয়া যায়। তবে এটা মেডিকেল সায়েন্সে স্বীকৃত যে গর্ভকালীন অবস্থায় চোখের দৃষ্টিতে পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়। এই কারণে ‘কেবল গর্ভাবস্থায়’ চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা মনে হলে কোনরকম ওষুধপথ্য নিতে মানা করেন চিকিৎসকরা।

৫. চ্যাডউইক’স টেস্ট
১৮৮৬ সালে আমেরিকান গাইনাকোলজিকাল এসোসিয়েশনের একটি সভায় ডা. জেমস চ্যাডউইক নামের একজন চিকিৎসক প্রথম মত দেন যে, গর্ভকালীন ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম সপ্তাহে যোনীপথে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। এতে করে সেখানে কোষগুলি গাঁঢ় নীলাভ অথবা লালচে বেগুনি মত রঙ ধারণ করে।

সেই বিজ্ঞানীর নামানুসারে এই পদ্ধতিটির নাম রাখা হয় ‘চ্যাডউইক’স সাইন টেস্ট’। সেকালে অবশ্য এই পদ্ধতির অত জনপ্রিয় হতে পারেনি। এর কারণ ছিল দুইটি। এক হচ্ছে রঙ এর ভিন্নতা বেশ সূক্ষ্ম বিধায় কেবল অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরাই কেবল বুঝতে পারতেন। আর দুই হচ্ছে সেই সময়ে খোদ পশ্চিমা সমাজও ছিল যথেষ্ট রক্ষণশীল; তাই নারী চিকিৎসক যেমন ছিল না, নারীদের চিকিৎসাও এখনকার মত এত সহজ ছিল না।

৬. খরগোশ বলে দিবে গর্ভবতী কিনা
১৯২০ সালে দুইজন জার্মান বিজ্ঞানী আশেইম ও জোনদেক মত দেন যে, গর্ভবতী নারীদের মূত্রে এমন একটি হরমোন আছে যা কিনা খরগোশের গর্ভাশয় এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনটি আসলে HCG (হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন), হিউম্যান প্রেগনেন্সি কিটে যার মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করা হয়।

এটি পদ্ধতিটি কাজ করে এভাবে- এক সিরিঞ্জ মূত্র একটি খরগোসের শরীরে প্রথমে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুশ করানো হতো। এর ৫ দিন পর একে মেরে ফেলে দেখা হত এর ডিম্বাশয়ের বৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কিনা। এই পদ্ধতিতে ইঁদুরও পরীক্ষা করা হত এবং একইরকম ফল পাওয়া যেত। পরে অবশ্য বিজ্ঞানীরা ব্যাঙ ব্যবহার করতেন। ব্যাঙ এর ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল যে ব্যাঙকে মেরে ফেলতে হত না। একজন নারী গর্ভবতী হোলে তার মূত্র ব্যাঙের শরীরে প্রবেশ করানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ব্যাঙটি ডিম দিত।

৭. প্রেগন্যান্সি কিট
বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ‘প্রেগন্যান্সি কিট’ মূত্রে থাকা HCG হরমোনের উপস্থিতি বলে দেয়, যে এই হরমোন কেবল গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শরীরে উৎপন্ন হয়। ১৯২০ সালে র‍্যাবিট টেস্টের হাত ধরেই পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে উদ্ভাবিত হয় এই প্রেগন্যান্সি কিট।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেগন্যান্সি কিট আবিষ্কার হয় আল্ট্রাসনোগ্রাফি আবিষ্কারেরও আট বছর পরে! এরপর ১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়।

মেডিকেল সায়েন্সে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, P for Pee and P for Pregnancy। অবাক না হয়ে পারা যায় না, মিশরীয়রা সেটি আবিষ্কার করেছিল আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগেই! এরপরে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, তবে অধিকাংশ পদ্ধতিতেই গর্ভবতী মায়ের মূত্রের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্তমানে প্রেগন্যান্সি কিটে গর্ভধারণের ১০ দিনের মাথায় জানতে পারা যায়। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এমন প্রেগন্যান্সি টেস্ট আসবে যা কিনা আরো দ্রুত বলে দিতে পারবে গর্ভধারণের কথা, এমনটাই আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.