সাংবাদিকতাকে দালালি নয় ঈশ্বরের সেবা হিসেবে দেখেছিলেন


যারা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়কে চেনেন না 
১৯৩৭-১৯৬২ তিনি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অর্থসঙ্কটে ভুগতে থাকা ঐতিহ্যবাহী এই পত্রিকাকে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। দৈনিক বসুমতী, সত্যযুগ, ভারতকথা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। একইভাবে অর্থাভাবে ক্লিষ্ট বসুমতীর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে পত্রিকাটিকে সচল করেন। তার কৃতিত্বে ক্রমে অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই পত্রিকা।সাংবাদিকতা ছাড়া যুদ্ধ সংক্রান্ত লেখালিখিতে খ্যাতিলাভ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার নানা লেখা প্রকাশিত হয় যেখানে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেয়া ও সামরিক সহায়তা প্রদানের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। 

পূর্ববঙ্গের ভয়াবহ ঘটনাবলীর সংবাদ যখন প্রথম আমাদের নিকট আসিয়াছিল, তখন উহার সত্যতা সম্পর্কে আমাদের মনেও গভীর সন্দেহ ছিল। কেননা, আধুনিক কোন রাষ্ট্র ও সমাজে সম্পূর্ণ নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র নরনারীর উপর এমন ব্যাপক অত্যাচার ওলাঞ্ছনা ঘটিতে পারে ইহা আমরা স্বাভাবিক কারণেই বিশ্বাস করিয়া উঠিতে পারি নাই। কিন্তু পাকিস্তানী লৌহ যবনিকা ভেদ করিয়া গত তিন সপ্তাহের মধ্যে যে অসংখ্য বিবরণী সংবাদপত্রে সরকারী দপ্তরে ও অন্যান্য ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট পৌঁছিয়াছে, সেগুলি নিঃসন্দেহে আমাদের বিশ্বাস ও অনুমানকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। ভদ্রবেশধারী কোন গভর্নমেন্টের অধীনে সমাজের এক বিরাট অংশের উপর অত্যাচারের এমন তান্ডবলীলা যাইতে পারে, বর্তমান যুগের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বেশী নাই। এজন্যই পি.টি.আইয়ের সংবাদদাতা উইলফ্রেড ল্যাজারাস স্বয়ং পূর্ববঙ্গের ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্ত করিয়া এবং সন্দেহাতীত সূত্রগুলি হইতে সংগৃহীত সংবাদগুলি যাচাই করিয়া এই মন্তব্য করিতে বাধ্য হইয়াছেন যে পূর্ববঙ্গের দাঙ্গা ইতিহাসের এক বিয়োগান্তক অধ্যায়।

এই বিয়োগান্তক অধ্যায়ের কিছু কিছু পরিচয় ও তিনি দিয়াছেন যেমন বাগেরহাট মহকুমার ৮০০টি বাড়ীর মধ্যে ৩টি ছাড়া বাকি সমস্তগুলি
ভস্মীভূত হইয়াছে। ঘটনার দুই মাস পরেও এই অঞ্চলে যাওয়া বিপজ্জনক। নারায়ণগঞ্জ বন্দরে বহু হিন্দু যাত্রী স্টিমারের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, তাঁহাদিগকে হত্যা কিংবা নদীতে নিক্ষেপ করা হইয়াছে ইঁহাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। বরিশালে একটি গ্রামে তিনশত নর-নারী এবং অন্য একটি গ্রামের একশত নর-নারী নিহত হইয়াছে। এই জেলার আটটি থানার সমূহ ক্ষতি হইয়াছে এবং চারিটি থানার গ্রামগুলি সম্পূর্ণ দগ্ধ হইয়াছে। ঢাকায় ছয়শত হইতে হাজার পর্যন্ত নিহত হইয়াছে বলিয়া প্রধানমন্ত্রী নেহেরু যে বিবৃতি দিয়াছেন তাহাও অত্যন্ত কম বলিয়া বহু দায়িত্বশীল ব্যক্তি অনুমান করেন। এখানে হিন্দুদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। বোধ হয় বহর পাঁচ কোটি টাকার কম হইবে না। অন্যান্য স্থানের কথা মিঃ ল্যাজারাসের বিবরণীতে নাই।

এই বিরাট বিয়োগান্তক ইতিহাসের সম্পূর্ণ পরিচয় কোন দিন জানা যাইবে কিনা সন্দেহ। মানুষের দুর্ভাগ্যকে, অপমানকে, লাঞ্ছনাকে যাঁহারা গোপন করিতে চাহেন, তাঁহারা আর যাহাই হউন, অন্তত আর্তের বন্ধু ও মনুষ্যত্বের উপাসক নহেন। অনেক সময় আমাদেররুচি, শালীনতাবোধ ও মানবিক সংস্কৃতি বাস্তবতার সহিত অতি রূঢ় কার্যে ও ক্রূর অবস্থাকে স্বীকার করিতে কুন্ঠা বোধ করে। কেননা, আমরা ভন্ডামিতে অভ্যস্ত নহি। কিন্তু আমাদের রুচি ও শালীনতা আহত হইলেও ঘটনার বাস্তবতা অসত্য বা মিথ্যা হইবে না।বরং এই নগ্ন ও ক্রূর সত্যকে স্বীকার করিয়া লইয়াই সম্মুখে দাঁড়াইতে হইবে। যদি ইহাকে আমরা ভীরুর মতো চাপা দিই কিংবা প্রতিকারহীন অসহায় মানুষের মত কেবল বেদনার বিলাপ ও আর্তনাদে অশ্রুজল রচনা করি, তাহা হইলেও আমরা এই সংকট হইতে ত্রাণ পাইব না। ব্যাধি যেখানে দেহের অন্তর্গত, সেখানে বাহ্যিক পরিচ্ছন্ন জামা পড়িলেই রোগ মুক্তি ঘটিবে না, সেই মুক্তির জন্য হয়তো নগ্ন ক্ষতস্থানে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হইবে। উহার নিষ্ঠুরতা দেখিয়া সাধারণ মানুষ ভয়ার্ত হইতে পারে, কিন্তু দক্ষ অস্ত্রোপচারক তাহাতে বিচলিত হন না। কারণ, তিনি জানেন যে, এই অস্ত্রাঘাত কল্যাণের জন্য, মৃত্যুপথ যাত্রীকে রক্ষা করিবার জন্য। সুতরাং বাস্তব অবস্থায় বিভীষিকার সম্মুখে তাঁহাকে স্থির মস্তিষ্কে ও অবিচলিত চিত্তে দাঁড়াইতে হয়। আমাদের গভর্নমেন্ট ও রাষ্ট্রনেতাদের নিকট এই অবস্থা দেখা দিয়াছে।

সরল সাহসের সহিত এক কথা স্বীকার করা উচিত যে, বাঙালী জাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হইয়াছে। যে বঙ্গভঙ্গ রোধ করিবার জন্য একদা স্বদেশী আন্দোলন দেখা দিয়াছিল এবং সেই আন্দোলন হইতে সমগ্র ভারতবর্ষ মুক্তি পথ যাহার প্রেরণা পাইয়াছিল, সেই বিচ্ছেদেরই অধিকতর ভয়াবহ রূপ আমাদের সম্মুখে দেখা দিয়াছে। সেদিনের বাঙালী প্রধানগণ আজিকার মত বিহ্বল ও হতবুদ্ধি হন নাই। সেদিনের ট্র্যাজেডিকে কেবল সাহায্যের ভাষা দিয়া গ্রহণ করা হয় নাই প্রাণের অগ্নিমন্ত্রে উহাকে তপস্যার দ্বারা গ্রহণ করা হইয়াছিল। বাঙালী জাতি ভাবপ্রবণ হইতে পারে, কিন্তু সেই ভাবপ্রবণতা তাহার অপরাধ নয়, বরং তাহার চরিত্রের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই বাঙালী রাজনীতি হইতে সাহিত্য ও শিল্পকলা পর্যন্ত সর্বত্র বিপ্লবীর ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারিয়াছিল। কিশোর বয়স্ক তরুণ অবলীলাক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জল্লাদের সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছিল – ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান রচনার দ্বারা মনুষ্যত্বের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছিল। ইহা নিছক অশ্রুজল, নিছক ভাবপ্রবণতার কথা নহে, ইহা সংগ্রামশীল জীবনের রূপ, ইহাই যোদ্ধার চরিত্র। এই সংগ্রামশীল জীবনের দাবীকে আজ চতুর্দিক হইতে দাবাইয়া রাখিবার চেষ্টা হইতেছে। কেননা, বাংলাদেশে আজ সেই সংগ্রামশীল স্বাধীনতার অভাব – যিনি এই দুর্দিনে অভয় মন্ত্র দিয়া সমগ্র বেদনার বিষপাত্রকে নীলকণ্ঠের মতো পান করিতে পারেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় হইতে সুভাষচন্দ্র বসু পর্যন্ত বাংলার দিগ্বিজয়ী পুরুষেরা আমাদের মধ্যে আর নাই। সুতরাং প্রবলের দম্ভ, বর্বরের অত্যাচার এবং মাতৃজাতির অপমানকে নীরবে দাঁড়াইয়া দেখিতে হইবে এবং রাষ্ট্র ও স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার জন্য একমাত্র সংযম ও শান্তির বাণীর আড়ালে আত্মগোপন করিতে হইবে। আবার এদিকে লক্ষ লক্ষ পলায়নপর নর-নারী ও শিশু হাজার হাজার বৎসরের জন্মভূমি হইতে পশুর মতো বিতাড়িত হইয়া অধিকতর দুর্গতিপূর্ণ জীবনের জন্য আশ্রয়সন্ধানে বাধ্য হইতেছে। যে বাঙালী একদা অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষালাভ করিয়াছিল, আজ সে ইতিহাসের অতি মর্মান্তিক বিয়োগান্তক অধ্যায়ের ম্লানমুখে দর্শক মাত্র। আমরা জানি না জাতির জনক গান্ধীজি জীবিত থাকিলে দুর্গত বাংলার এই অগ্নিপরীক্ষায় কী উপদেশ এবং কী নির্দেশ দিতেন। তবে, এইটুকু জানি যে, যেখানে অহিংস প্রতিরোধ সম্ভব নয়, সেখানে তিনি কাপুরুষের মতো পলায়ন আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিতেন না। তাঁর অহিংসা
ছিল বীর্যবান মানুষের, যে মানুষ অন্যায়ের সঙ্গে, পাপের সঙ্গে, অত্যাচারের সঙ্গে আপোষ করে না। এজন্যই তিনি বলিয়া গিয়াছেন:

I would rather have India resort to arms in order to defend her honor than she would, in a cowardly manner become or remain a helpless witness to her own dishonor

“অর্থাৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের অসম্মানের প্রতি কাপুরুষের মতো নিরব দর্শক সাজিয়া থাকার বদলে আমি বরং ভারতবর্ষের সম্মান রক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণেরই পরামর্শ দিব।” আজ গান্ধীজীর যাঁহারা উত্তরাধিকারী, যাঁহারা তাঁহার নামে এত বিজ্ঞাপন প্রচার করিয়া থাকেন তাঁহাদের উদ্দেশ্যে আমরা সেই বাপুজীর অমৃতমন্ত্র, এই অগ্নিমন্ত্র স্মরণ করাইয়া দিতে চাই। বাঙালী জাতি ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য অপরিমিত ত্যাগ ও দুঃখ স্বীকার করিয়াছে, কিন্তু উহার জন্য সে আত্মবিনাশ মানিয়া লহিতে প্রস্তুত নহে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক ও অবিচ্ছেদ্য – আজিকার ট্রাজেডির মধ্যে ভাবীকালের এই ইতিহাস অপেক্ষা করিতেছে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.