ম্যাকলাস্কিগঞ্জ: ভারতের যেখানে ইংরেজরা এখন ভোজপুরিতে কথা বলে


Odd বাংলা ডেস্ক: গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেল লাইন পাতার কাজ চলছে পুরোদমে। সাহেবরা বাঙালি বাবু আর বিহারি কুলিদের নিয়ে ঘন জঙ্গল কেটে রেল লাইন পেতে চলেছে মাইলের পর মাইল। প্রায় প্রতিদিন বাঘ মেরে সাহেব ছবি তোলে। মাথায় টুপি, হাতে বন্দুক। সামনে বাঘ শুয়ে আছে। সাহেবের একটা পা বাঘের পেটের উপর। সাহেব বেশ গর্বিত বাঘ মেরে। আশেপাশে সবাই সাহেবকে ঘিরে আছে। সেই সাদাকালো ফটো ফ্রেম বন্দি হয়ে সাহেবের ঘরের নাকি শোভা বাড়াত।

জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা সাহেবদের বেশ ভালো লাগলো। ঠিক ইংল্যান্ডের মতন পরিবেশ কিছুটা। আবহাওয়া সারা বৎসরই বেশ মনোরম। বেশ জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। জায়গাটা ঠিক বিলেতের মতন। মালভূমি অঞ্চল। চারিদিকে উঁচু নিচু জমি। ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর জায়গা। সাহেবদের ঘরোয়া টেবিলে জায়গাটা একটা আলোড়ন তুলল। এ যেন মিনি লন্ডন অফ ইন্ডিয়া।

এদিকে বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডের অর্থনীতির কোমর আস্তে আস্তে ভাঙছে। কলকাতার সাহেব কোম্পানির অফিসের ঝাঁপি আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। অ্যাংলো সাহেবদের চাকুরী থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে অ্যাংলো সাহেবদের সংখ্যা বেশ সারা দেশে। অফিস কাছারিতে তাদের ভীষণ দাপট। তারা খুব সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে আর নাকি নির্ভুল টাইপ করতে পারে। অফিসের আদব-কায়দা বেশ জানে। বিলেতের সাহেবরাও তাদের ফেলে দিতে পারে না। 


চাকুরী যাচ্ছে একে একে অ্যাংলো সাহেবদের। তারা সবাই ঠিক করলো যে এক এক করে সবাই ব্রিটেনে চলে যাবে। ব্রিটেনের মহারানীর বিশাল সাম্রাজ্য। সেখানে নাকি সূর্য অস্ত যায় না। সারা পৃথিবী থেকে যদি সব অ্যাংলো সাহেবরাই ব্রিটেনে যেতে চায় তাহলে তো মহা মুশকিল। একটা নাক উঁচু ভাব সাহেবদের ছিল। কিছু লোক ফাঁক ফোকর গোলে চলেও গিয়েছিল। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হওয়ায় সে দেশে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। কোথায় যাওয়া যায় ভেবে ভেবে দিন গোনে তারা। এদের কিছু একটা করতে হবে এই চিন্তা ইংরেজ শাসকদের ছিল। জলে ফেলে তো আর দিতে পারে না তাদেরকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের প্রতিনিধিরা বহুদিন আগে থেকেই নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে। দাবি আদায় করেই ছাড়ে তারা শেষ পর্যন্ত। ম্যাকলুস্কি সাহেব তখন এই জায়গার নাম সবাইকে বলে। চলো, আমরা সবাই মিলে সেখানে একটা কলোনি গড়ি। রাতু মহারাজের কাছ থেকে সেই জায়গা চাওয়া হল। তিনি জায়গা দান করলেন। তারা ভাবতে শুরু করল যে ইন্ডিয়াই আমাদের মাতৃভূমি। এখানেই আমাদের থাকতে হবে। সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ম্যাকলুস্কিতে এসে থাকবার অনুরোধ করা হল।

জঙ্গলের মধ্যে গড়ে উঠলো প্রচুর বাংলো। সেখানে এসে সাত পাঁচ না ভেবেই তারা থাকতে শুরু করল। বাংলোর চারিদিকে বিশাল জায়গা আর তাতে নানান ফলের গাছ লাগল। প্রথমে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে একটু ঝামেলা শুরু হল। তবে অ্যাংলো সাহেবদের দাপটের কাছে তারা হার স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত। তাদের এলাকায় স্থানীয়দের যাওয়ার অনুমতি নাকি ছিল না। অ্যাংলো সাহেবরা নাকি সেই সময় ঘোড়ায় চেপে কাঁধে বন্দুক নিয়ে এক বাংলো থেকে অন্য বাংলোয় যাতায়াত করত।

দেখতে দেখতে দেশ স্বাধীন হল। ইংরেজরা দেশে ফিরে গেল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নতুন প্রজন্ম আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করলো। তবে বয়স্করা আর ফিরে যায়নি। আস্তে আস্তে বাংলো গুলো জলের দামে বিক্রি হয়ে যেতে লাগলো মাফিয়াদের হাতে। কিছু বাংলো আমাদের কলকাতার বাবুরা কিনে ছিল একসময়। কেউই শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারেননি। আজও বিশাল বিশাল বাংলো গুলো পরে আছে জীর্ণ অবস্থায়। বাংলোর জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতাম পুরনো আসবাবপত্র শুধু রয়েছে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.