রাণী সংযোগীতা: পদ্মাবতী ছাড়াও যে কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ নারী সম্মান বাঁচাতে চিতায় লাফ দিয়েছিলেন
বিক্রম পাঠক: পদ্মাবতী বা পদ্মিনির পরে দ্বিতীয় যে রমণীর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক আছে তিনি হলেন চাঁদ বারদাই দ্বারা রচিত আরেকটি মহাকাব্য পৃথ্বীরাজ রাসোতে বর্ণিত উত্তরপ্রদেশের কনৌজের রাজকুমারী সংযোগীতা। মহাকাব্য রাসোর বর্ণনা অনুযায়ী পান্না রায় নামে এক শিল্পীর অঙ্কিত তৈল চিত্রে রাজকুমারী সংযোগীতার অপূর্ব রূপ-সৌন্দর্য দর্শন করে তাঁর প্রেমে পড়ে যান দিল্লির শেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান, এবং পরবর্তীকালে তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে কোনোজে রাজকুমারী সংযোগীতার স্বয়ম্ভর সভায় প্রবেশ করে তাঁকে হরণ করে নিজের রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে এসে বিবাহ করেন। কনৌজের এই রাজপরিবার ছিল ব্রাহ্মণ। মূলত কান্যকুব্জ জাতীর ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁরা। যাঁদের ভগবান শ্রী পরশুরামের বংশধরও বলা হয়ে থাকে।
কন্যার এরূপ অপহরণের ফলে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হন সংযোগীতার পিতা রাজা জয়চাঁদ এবং পৃথ্বীরাজকে তাঁর কুকর্মের উচিত শিক্ষা দিতে গজনীর তুর্কি সুলতান মহম্মদ ঘোরীকে দিল্লি আক্রমণ করবার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
এদিকে দিল্লির অনতিদূরে গজনীর তুর্কি বাহিনী উপস্থিত হয়েছে জেনেও রাজা পৃথ্বীরাজ নাকি রানি সংযোগীতার প্রেমে এতোই মজে ছিলেন যে মাতৃভূমিকে বিদেশি আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেরকম কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি প্রাথমিক ভাবে। পরে যখন মিত্র মেবার নরেশ রাওয়াল সমর সিংহের উপদেশে তাঁর টনক নড়ে তখন বহু বিলম্ব হয়ে গেছে। প্রবল তুর্কি শত্রু গৃহের দোরগোড়ায় উপস্থিত এদিকে দিল্লির সেনারা বিক্ষিপ্ত।
রাসোর বর্ণনা অনুসারে তরাইনের ভয়াবহ দ্বিতীয় যুদ্ধের পর তুর্কি বাহিনীর সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় অরক্ষিত দিল্লি নগরে অনুপ্রবেশ করে পৃথ্বীরাজের লালকোট (বিষ কন্যায় যার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে) কেল্লা অধিকার করে। এরপর খাজা মঈনুদ্দিন চিস্তির সাহায্যে তাঁরা রানি সংযোগীতা সহ চৌহান রাজবংশের অন্যান্য সম্ভ্রান্ত নারীদের বন্দিনী করে ঘোরীর তুর্কি শিবিরে পেশ করে।
চিত্র শিল্পী পান্না রায়ের আঁকা ছবিতে সংযোগীতার যে রূপ ধরা পড়ে, তা অতুলনীয়, Image Source: Google |
কিন্তু এই কাহিনী নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। অনেকেই বলেন সংযোগীতার মতো সেরকম সুন্দরী নারীর কোনো অস্তিত্ব নাকি তখন কনৌজে ছিল না। আবার কেউ বলেন সংযোগীতা আসলে এক গরীব পুরোহিত পরিবারের মেয়ে ছিল। এদিকে পৃথ্বীরাজ বিজয় কাব্যগ্রন্থ, মেরুতুঙ্গার প্রবন্ধ চিন্তামনি, প্রবন্ধ কোষা আর কন্নড়দাদেব প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো অনুযায়ী কনৌজের রাজা জয়চাঁদের দুই পুত্র সন্তান ছিল। তাঁদের নাম যথাক্রমে হরিশচন্দ্র এবং গোবিন্দচন্দ্র। কিন্তু সংযোগীতা নামে কোন কন্যা সন্তান ছিল না রাজা জয়চাঁদের। অপরদিকে নিজের মৃত্যুর সময় দিল্লি নরেশ পৃথ্বীরাজ মাত্র 25-26 বর্ষীয় এক অবিবাহিত যুবা ছিলেন। তাঁর মা রাজমাতা কর্পূর দেবী গঙ্গা পাড়ের কোন এক অঙ্গ রাজ্যের অপরূপা রূপসী রাজকুমারী সংযুক্তার সাথে পৃথ্বীরাজের বিবাহ স্থির করেছিলেন। কিন্তু তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলে হতভাগ্য পৃথ্বীরাজের পক্ষে রাজকুমারী সংযুক্তাকে আর বিবাহ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে যুদ্ধে পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে বিধর্মী তুর্কিদের অত্যাচার আর ধর্ষণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তুর্কিরা রাজধানী দিল্লিতে আসার বহু পূর্বেই রাজমাতা কর্পূর দেবী সহ চৌহান রাজবংশের দিল্লি স্থিত সব রমণীরাই বিষ কন্যায় বর্ণিত সূর্য কুণ্ডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গণ চিতা প্রজ্বলিত করে জহরব্রত পালন করেন।
Post a Comment