মুসলমান হয়েও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, আজ কাইফি আজমির জন্মদিন


Odd বাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি কাইফি আজমির কলমে জ্বলে উঠেছিল দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের প্রতি তীব্র ঘৃণা। সেসময় কাইফি আজমি একজন প্রথিতযশা কবি ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নির্যাতন কাইফি আজমিকে ব্যথিত করে। তিনি কবিতার মাধ্যমে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। কবিতা লিখে ও পাঠ করে তিনি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এর সমর্থনে ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে কাইফি আজমির অসাধারণ উর্দু কবিতা। বাংলায় যার অনুবাদ এরকম,



“শুধু তো একটি দেশ নই যে জ্বালিয়ে দেবে
প্রাচীর তো নই একেবারে ভেঙে ফেলবে
সীমান্ত নই যে মুছে ফেলবে পুরোপুরি।
টেবিলে সারা জাহানের যেই তুমি বিছিয়ে রেখেছ পুরনো নকশা,
যেখানে অর্থহীন কিছু রেখা ছাড়া আর কিছু নাই।
তুমি আমাকে কোথায় খুঁজছ সেই মানচিত্রে।
আমি তো পাগলপারা মানুষের মনে এক দারুণ বাসনা।
দুর্জয় দলিতের স্বপ্ন
লুণ্ঠন যখন সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়
অত্যাচার যখন সহ্য অতিক্রম করে
তখন হঠাৎ কোনও এক কোণে আমি দৃশ্যমান হই
কোনো একটি হৃদয় থেকে উৎসারিত হই।
এর আগেও তুমি দেখেছ আমাকে
প্রাচ্যে নতুবা কখন পাশ্চাত্যে
শহরে অথবা কোন গ্রামে
বস্তিতে নতুবা কোনো জঙ্গলে দেখে থাকবে
যার কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা নেই
ইতিহাস তো একটি এমন বিষয়
যা থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না
আড়ালে মানুষ বসে থাকে ঠিকই
আমি বিজয়ী মাঝে মাঝে হয়েছি পরাজিত
হত্যাকারীদের ফাঁসিতে চড়িয়েছি
আবার কখনও নিজেই শূলে চড়েছি
শুধু এইটুকু পার্থক্য
ঘাতকেরা যেই হোক অবশ্যই মারা পড়বে
আমি মরতে পারি না, আমার মৃত্যু নেই
তুমি কতই নির্বোধ
খয়রাতে সংগৃহীত ট্যাংক নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছো
দিনরাত অবিরাম নাপাম বোমা নিক্ষেপ করছ
দেখো একদিন তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে
আমার কোনও হাতে শৃঙ্খল পরাবে তুমি
আমার হাত তো আছে সাত কোটি
ঘাড় থেকে কয়টি মাথা বিচ্ছিন্ন করবে”

উর্দু কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ কাইফি আজমির জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ মে উত্তর প্রদেশের আজম গড়ে। কাইফি আজমির মতে, কবিতা সমাজ পরিবর্তনে বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যবহার হওয়া উচিত। কাইফি আজমির আসল নাম আতহার হোসাইন রিজভি। উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে মিজওয়ান-এর জমিদার পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। কিন্তু জমিদারির গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে ফেলেন তিনি। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৪২ সালে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। তার পরের বছর যোগ দিলেন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)তে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ অব্দি পার্টি কার্ড সযত্নে ও সক্রিয়ভাবে রেখে দিয়েছিলেন। আলি সরদার জাফরি সম্পাদিত পার্টির উর্দু মুখপত্র ‘কউমি জং’-এ লেখা শুরু করেন। থেকে গেলেন মুম্বাই শহরে। তার পর থেকে সমাজ সচেতন কবিতা শুরু করেন।



কাইফি আজমির কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ১১ বছর বয়সে। এক মুশায়রায় পড়লেন একটি গজলের গীতিকবিতা,

‘ইতনা জো জিন্দেগী মে কিসি কি খালাল পাড়ে
হাঁসনে সে হো সুকুন না রোনে কাল পাড়ে’

সুবিখ্যাত কন্ঠশিল্পী বেগম আখতারের কণ্ঠে অমরত্ব লাভ করে এই গজলটি। তারপরে কলম আর থামেনি, বার বার তাঁর লেখার যাদুকরী প্রভাব সবাইকে মোহিত করেছে। বেগম আখতার পরবর্তীকালে কাইফি সাহেবের লেখা আরও বেশ কিছু গজল গেয়েছেন; যেমন

‘মায় ঢূঁড়তা হুঁ জিসে
উয়ো জাঁহাঁ নহি মিলতা জিসে’

একবার এক মেহফিল ছিল কাইফি সাহেবের গীতি আর সেগুলি গাইলেন বেগম আখতার। সেখানে কাইফি সাহেব বলেছিলেন, বেগম আখতারের গজল শোনা মানে গজলের বাণীকে দেখতে পাওয়া।

কাইফি আজমি উর্দু, ফারসি ও হিন্দী তিন ভাষাতেই ছিলেন সাবলীল, স্বচ্ছন্দগতি। একাধিক বই লিখেছেন – আখির-ই-সাব, শারমায়া, আওয়ারা সাজদে, কৈফিয়াত, নঈ গুলিস্তাঁ এবং আরো কয়েকটি। ১৯৫২ সালে শহীদ লতিফের ছবিতে গান লেখার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রজীবনের শুরু। অচিরেই হয়ে ওঠেন এক জনপ্রিয় গীতিকার। ‘শামা’, ‘কাগজ কি ফুল’, ‘শোলা অর শবনম’, ‘অনুপমা’, ‘আখেরি খত’, ‘হাকিকত’, ‘আর্থ’ প্রভৃতি নানা ছবির সংলাপও লিখেছিলেন। চেতন আনন্দের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘হির রানঝা’র সংলাপ ছিল কবিতায়। এক অভূতপূর্ব ইতিহাস গড়েছিলেন তিনি এভাবে। এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবির সংলাপ ও চিত্রনাট্য কে ভুলতে পারে? ইসমাত চুঘতাই-এর কাহিনী থেকে নেওয়া। মনে পড়ে অবিস্মরণীয় পঙক্তিচয়;

‘আজ রাতমেঁ বহোত গর্ম হাওয়া হ্যায়
আজ রাত নিঁদ নেহি আতে’

এই চলচ্চিত্র তাঁকে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন – আফ্রো এশীয় রাইটার্স লোটাস পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার, মহারাষ্ট্র গৌরব ও আরও অনেক। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৮০ সালে। তাঁর বিখ্যাত লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আউরত’, ‘মাকান’, ‘দাইরা’, ‘বাহুরুপনি’ ইত্যাদি। ‘মেরি আওয়াজ সুনো’ নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর গান নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল।

কাইফি আজমির লেখা অমর যে সব গান কখনো পুরনো হবে না, তার মধ্যে আছে লতা মঙ্গেশকর ও তালাত মাহমুদের যৌথ কন্ঠে ‘ডর লাগে দুনিয়া সে’ (বুযদিল), আবার লতাজির গলাতেই ‘চলতে চলতে ইয়ু হি কোহি মিল গিয়া’ (পাকিজা) বা ‘ঝুম ঝুম ঢলতে রাত’(কোহরা), মহম্মদ রফির গলায়, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল মেরে কাম কি নেহি’ (হীর রঞ্ঝা) ও ‘কর চলে হাম ফিদা ওয়াতন সাথিওঁ’ (হকিকত), হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’ (কোহরা) – আরও অনেক অনেক। জসবিন্দর সিং-এর ‘তুমহারে জুলফি কি সায়ে মেঁ’ অনন্য এক গান।

নারী অধিকারের পক্ষে ও ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী সদা উদ্যত ছিল। কবি ১৯৪৭ সালে শওকত আজমির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কাইফি সাহেবের বিভিন্ন সময়ের সাক্ষাৎকার থেকে থেকে উঠে এসেছে তাঁর বেড়ে ওঠা, সেই মিজওয়ান গ্রামের কথা, শওকতের সঙ্গে কাইফির পরিচয় থেকে পরিণয়, ১৯৫০-এর দশকে মুম্বাইয়ে লড়াকু দিনগুলো, মিল শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ ও সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে কাইফি-শওকতের ভালোবাসা।

বাংলাদেশ ভোলেনি বন্ধু কবিকে সম্মানিত করতে। কাইফি-শওকতকে নিয়ে একটি সংকলন ‘ইয়াদ কি রেহগুজার’ এক বিরল গ্রন্থ, যা অন্তত বাংলায় ভাষান্তরিত হলে আবেগপ্রিয় বাঙালি পাঠকদের কাছে হয়ে উঠবে নিত্যসঙ্গী। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র শিল্পী ও নারীবাদী নেত্রী শাবানা আজমী মানবতাবাদী কবি কাইফি আজমীর কন্যা।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.