তৈরি করেছিলেন আজাদ হিন্দ, কংগ্রেস হাই কমান্ড বলেছিল সাহায্য করবে না
Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ শতকের গোড়ার দিকে কোনো কোনো চরমপন্থী বিপ্লবী দেশের বাইরে গিয়ে সশস্ত্র
বাহিনী গঠন করে ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে উদ্ধার করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
তাঁদেরই একজন ছিলেন রাসবিহারী বসু। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী চলে যান জাপানে।
সেখান থেকে প্রবাসী ভারতীয়দের সংগঠিত করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র
সামরিক বাহিনী স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ব্রিটিশ ভারতীয়
সেনাবাহিনীতে সেই সময় অসংখ্য ভারতীয় জওয়ান চাকরি করতেন। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় জাপানের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ বাধলে
এদের একটি বিরাট অংশ জাপানিদের হাতে বন্দী হন।
১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানের রাজধানী টোকিয়োতে ভারতীয়দের একটি সম্মেলনে গঠিত হয় 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ' বা 'ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ'। ১৯৪২ সালে ব্যাংককে আরও একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই রাসবিহারী বসুকে লিগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনী (ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি বা আইএনএ) নামে একটি সামরিক বাহিনী গডে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দী ৪০,০০০ ভারতীয় সেনা নিয়ে গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ। ক্যাপ্টেন মোহন সিং ফৌজের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। উক্ত সম্মেলনেই সুভাষচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করার জন্য। সুভাষচন্দ্র টোকিয়োতে এসে পৌঁছান ১৯৪৩ সালের জুন মাসে। পরের মাসে সিঙ্গাপুরে এসে ফৌজে যোগ দেন। রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দেন। বাহিনী সুভাষচন্দ্রকে অভিবাদন জানায় 'নেতাজি' নামে। সিঙ্গাপুরেই নেতাজি স্থাপন করেন আরজি-হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ বা অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের। কংগ্রেসের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে' গানটি নির্বাচিত হয় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে। নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের দুটি প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন – একটি রেঙ্গুনে, অপরটি সিঙ্গাপুরে। জাপান সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের যুদ্ধে হারিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার ব্রিটিশদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে এই দ্বীপাঞ্চল জাপানি কর্তৃপক্ষ তুলে দেয় আজাদ হিন্দ সরকারের নামে। নেতাজি স্বয়ং আসেন আন্দামনে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করেন 'শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ'। এরপরই শুরু হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধাভিযান।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রথমে তিনটি ব্রিগেড গঠন করেছিল – গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড ও নেহেরু ব্রিগেড। পরে সুভাষ ব্রিগেড ও রানি ঝাঁসি ব্রিগেড নামে আরও দুটি ব্রিগেড গড়ে তোলা হয়। সুভাষ ব্রিগেড ছিল বাহিনীর বাছাই করা সেনাদের নিয়ে গঠিত। নেতাজির অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই ব্রিগেডের সদস্যরা ব্রিগেডের নামকরণ তাঁর নামে করেছিলেন। রানি ঝাঁসি ব্রিগেড ছিল পুরোপুরি মহিলা-সেনাদের নিয়ে গঠিত একটি ব্রিগেড। প্রবাসী ভারতীয়রা ফৌজকে অর্থ ও রসদ দুইই জুগিয়েছিল দু-হাত ভরে। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্লোগান ছিল 'জয় হিন্দ' ও 'দিল্লি চলো'। নেতাজি ডাক দিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।'
জাপানি বাহিনীর সঙ্গে সমান তালে যুদ্ধ চালিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী পৌঁছে গেল ব্রহ্মদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে। সেদিনটি ছিল ১৯৪৪ সালের ১৮ মার্চ। মুক্ত ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো উড়ল জাতীয় পতাকা। যদিও ইম্ফলের যুদ্ধে পিছু হঠতে হল আজাদ হিন্দ বাহিনীকে। এরপরই যুদ্ধে জাপানিদের পরাজয় তাদের জয়ের আশা শেষ হয়ে গেল।
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশদের আক্রমণে পিছু হঠলেন নেতাজিও। রেঙ্গুন থেকে চলে এলেন সিঙ্গাপুরে, সেখান থেকে ব্যাংককে। এই বছরই মার্চ মাসে খবর পাওয়া গেল একটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নেতাজির। প্রকৃত সত্য অনাবিষ্কৃতই থেকে গেল।
১৯৪৩ সালে টোকিও সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা দিচ্ছেন।
এই হল নেতাজি সুভাষ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বগাথার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে বাধ্য, নেতাজি এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়ক। কিন্তু কোনো বিপ্লব বা কোনো অভ্যুত্থানই সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় না, যদি সেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের বদলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিছক একজন বিপ্লবী নন, তিনি ছিলেন এক দূরদ্রষ্টা রাষ্ট্রনেতা। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রবিপ্লব আমরা অনেক দেখেছি ও দেখছি। কিন্তু ক'জন নেতা বিপ্লবোত্তর-উদ্ভুত সমস্যার অনুপুঙ্খ অনুধ্যানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছেন বিপ্লবের পথে? ক'জন নেতাই বা নিজের স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে বলি দিয়ে দেশের স্বার্থকেই জীবনের একমাত্র ব্রত করে তুলেছেন?
সুভাষচন্দ্রের একটি স্বপ্নের ভারত ছিল। কলকাতায় মহাজাতি সদনের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে একদিন তিনি বলেছিলেন, "'যে স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়েছি তা' শুধু স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নয়। আমরা চাই ন্যায় ও সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন রাষ্ট্র – আমরা চাই এক নূতন সমাজ ও এক নূতন রাষ্ট্র, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম আদর্শগুলি।" আবার শুধুমাত্র নামসর্বস্ব রাজনৈতিক স্বাধীনতার মোহও তাঁর ছিল না। তিনি বিলক্ষণ জানতেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীন তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র বিদেশির হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই না। জাপান বা জার্মানির সাহায্য নেওয়ার সময়ও তাঁকে সদা সতর্ক থাকতে হয়েছিল, যাতে সেই সাহায্যের বিনিময়ে একদিন না ভারতের মাথা বিকিয়ে যায়। আজাদ হিন্দ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে জাপানের আর্থিক ঋণ শোধের উদ্যোগ সেই সতর্ক মনোভাবেরই বার্তাবহ। ভারতীয় অর্থনীতিতে সুভাষচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ দান পরিকল্পনার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। সোভিয়েত ধাঁচে ভারতে পরিকল্পনার অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে সুভাষচন্দ্রেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এই জন্য গান্ধীবাদী অর্থনীতিদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তাঁর পথই যে সঠিক ছিল, স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী।
যুদ্ধের ময়দানের সুভাষচন্দ্রের ব্যর্থতার কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানায়ক শাহনওয়াজ খান ফৌজের পরাজয়ের জন্য জাপানিদের দায়ী করেছেন। তাদের অহেতুক কালক্ষেপ এবং কিছুক্ষেত্রে ফৌজের প্রতি অবান্তর অনাস্থা ফৌজের গতিকে ব্যাহত করেছিল। জাপানের সহায়তা মুক্তহস্তের সহায়তা ছিল না, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে জাপানের পশ্চাদপসারণ। উপরন্তু কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা কেউই নেতাজির নীতিকে সমর্থন করেননি। কমিউনিস্টদের নেতাজি-বিরোধিতা তো রীতিমতো অশ্লীলতার পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছিল – আজও সেকথা বহুআলোচিত। কংগ্রেসও নেতাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদেরই নৈতিক সমর্থন জোগায়। তবে সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ব্রিটিশ বাহিনীর ক্রমাগত অপপ্রচার, সংবাদমাধ্যমের উপর কঠোর নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞার ফলে নেতাজি ও তাঁর বাহিনীর আদর্শ ও কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ অবহিত হতে পারেননি। যুদ্ধোদ্ভুত দেশের করুণ পরিস্থিতিও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তুমুল উদ্যোগে গণসংগ্রাম পরিচালনার প্রতিকূলে ছিল।
কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আপাত-পরাজয় যে আদৌ পরাজয় না তা টের পাওয়া যায় কিছুদিন পরেই। নেতাজির অন্তর্ধানের পর ('নেতাজির মৃত্যু' শব্দবন্ধটি বহু মিথ্যা ও রহস্যের দ্বারা আবৃত, তাই সেই শব্দবন্ধটি পরিহার করলাম) ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধবন্দী আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনানীদের বিচারের সভা বসায় দিল্লির লালকেল্লায়। শাহনওয়াজ খান, গুরুবকস সিং ধিলন, প্রেম সেহগল প্রমুখের বিরুদ্ধে আনা হয় রাজদ্রোহিতার অভিযোগ। কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকে তাঁদের মুক্তির দাবি ওঠে। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে ১৬০টি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে। কংগ্রেস কতকটা বাধ্য হয়েই গঠন করে আইএনএ ডিফেন্স কমিটি। জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই দেশাই, তেজবাহাদুর সপ্রু, কৈলাসনাথ কাটজু ও আসফ আলির মতো নেতাদের এগিয়ে আসতে হয় বাহিনীর সমর্থনে। যদিও ঐতিহাসিক নিমাইসাধন বসু মনে করেন, কংগ্রেস নেতাদের এহেন আচরণ ছিল নেতাজির জনপ্রিয়তাকে ভাঙিয়ে নির্বাচনী ফায়দা লোটার অভিসন্ধিপ্রসূত। সে যাই হোক, ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের দোষী সাব্যস্ত করলেও, শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতি নরম হতে বাধ্য হয়। আর নেতাজির কীর্তিকাহিনির যথাযথ খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভারতে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের নিরামিষ আন্দোলন তিন দশকের প্রচেষ্টায় যা করতে পারেনি, সুভাষচন্দ্রের তথাকথিত ব্যর্থ সামরিক অভিযান কয়েক মাসের মধ্যে তা করে দেখায়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন শাখাতেই ভারতীয় জওয়ানদের মধ্যে অভূতপূর্ব অসন্তোষ দানা বাঁধে। ১৯৪৬ সালে বোম্বাইয়ের নৌবিদ্রোহ প্রমাণ করে দেয়, জন-অসন্তোষ এবার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে তাকে ঠেকানোর উপায় নেই। ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর হাতে এত বড়ো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি ব্রিটিশদের। একথা বললে আদৌ অত্যুক্তি করা হবে না যে, স্বাধীনতার জন্য অসূর্যাস্ত-পশ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর যদি প্রকৃত কোনো চাপ কেউ দিয়ে থাকেন তবে তিনি একমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
সুভাষচন্দ্র বিরুদ্ধে কারো কারো অভিযোগ হিটলার ও মুসোলিনীর মতো নেতার সাহায্য গ্রহণ। একথা মনে রাখতে হবে, নেতাজি 'শত্রুর শত্রু পরম মিত্র' নীতির বশেই তাদের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। সেই অবস্থায় নেতাজির সামনে বিকল্পও কিছু ছিল না। কিন্তু সাহায্য প্রার্থনা করলেও নেতাজি নিজে কোনোদিন ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেননি। হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন সুভাষ। পছিলেন নাৎসীদের রোষনজরেও। কিন্তু ইতালি, জার্মানি বা জাপান কারোরই হাতের পুতুলে পরিণত হননি। তাঁর একমাত্র কারণ সুভাষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি। গীতায় বলেন, সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতের বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারংবার আবির্ভূত হন। দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয় তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের দেশনায়ক।" কবিগুরুর উচ্চারণ মিথ্যা হয়নি। তাঁর চরম বিরোধীও একদিন তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ জানুয়ারি গান্ধীজি তাঁকে 'প্রথম ভারতীয় ও শেষ ভারতীয়' বলে বর্ণনা করেন। আর ব্রিটিশ সরকার? ব্রিটিশ সরকারের একটি গোপন রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, "সুভাষচন্দ্র বসু হয়তো মারা গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কাজের অনেকটাই আজও বেঁচে আছে।"
১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানের রাজধানী টোকিয়োতে ভারতীয়দের একটি সম্মেলনে গঠিত হয় 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ' বা 'ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ'। ১৯৪২ সালে ব্যাংককে আরও একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই রাসবিহারী বসুকে লিগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনী (ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি বা আইএনএ) নামে একটি সামরিক বাহিনী গডে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দী ৪০,০০০ ভারতীয় সেনা নিয়ে গড়ে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ। ক্যাপ্টেন মোহন সিং ফৌজের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। উক্ত সম্মেলনেই সুভাষচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করার জন্য। সুভাষচন্দ্র টোকিয়োতে এসে পৌঁছান ১৯৪৩ সালের জুন মাসে। পরের মাসে সিঙ্গাপুরে এসে ফৌজে যোগ দেন। রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দেন। বাহিনী সুভাষচন্দ্রকে অভিবাদন জানায় 'নেতাজি' নামে। সিঙ্গাপুরেই নেতাজি স্থাপন করেন আরজি-হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ বা অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের। কংগ্রেসের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে' গানটি নির্বাচিত হয় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে। নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের দুটি প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন – একটি রেঙ্গুনে, অপরটি সিঙ্গাপুরে। জাপান সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের যুদ্ধে হারিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার ব্রিটিশদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে এই দ্বীপাঞ্চল জাপানি কর্তৃপক্ষ তুলে দেয় আজাদ হিন্দ সরকারের নামে। নেতাজি স্বয়ং আসেন আন্দামনে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করেন 'শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ'। এরপরই শুরু হয় আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধাভিযান।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রথমে তিনটি ব্রিগেড গঠন করেছিল – গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড ও নেহেরু ব্রিগেড। পরে সুভাষ ব্রিগেড ও রানি ঝাঁসি ব্রিগেড নামে আরও দুটি ব্রিগেড গড়ে তোলা হয়। সুভাষ ব্রিগেড ছিল বাহিনীর বাছাই করা সেনাদের নিয়ে গঠিত। নেতাজির অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই ব্রিগেডের সদস্যরা ব্রিগেডের নামকরণ তাঁর নামে করেছিলেন। রানি ঝাঁসি ব্রিগেড ছিল পুরোপুরি মহিলা-সেনাদের নিয়ে গঠিত একটি ব্রিগেড। প্রবাসী ভারতীয়রা ফৌজকে অর্থ ও রসদ দুইই জুগিয়েছিল দু-হাত ভরে। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্লোগান ছিল 'জয় হিন্দ' ও 'দিল্লি চলো'। নেতাজি ডাক দিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।'
জাপানি বাহিনীর সঙ্গে সমান তালে যুদ্ধ চালিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী পৌঁছে গেল ব্রহ্মদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে। সেদিনটি ছিল ১৯৪৪ সালের ১৮ মার্চ। মুক্ত ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো উড়ল জাতীয় পতাকা। যদিও ইম্ফলের যুদ্ধে পিছু হঠতে হল আজাদ হিন্দ বাহিনীকে। এরপরই যুদ্ধে জাপানিদের পরাজয় তাদের জয়ের আশা শেষ হয়ে গেল।
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশদের আক্রমণে পিছু হঠলেন নেতাজিও। রেঙ্গুন থেকে চলে এলেন সিঙ্গাপুরে, সেখান থেকে ব্যাংককে। এই বছরই মার্চ মাসে খবর পাওয়া গেল একটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নেতাজির। প্রকৃত সত্য অনাবিষ্কৃতই থেকে গেল।
১৯৪৩ সালে টোকিও সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা দিচ্ছেন।
এই হল নেতাজি সুভাষ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বগাথার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে বাধ্য, নেতাজি এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়ক। কিন্তু কোনো বিপ্লব বা কোনো অভ্যুত্থানই সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় না, যদি সেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের বদলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিছক একজন বিপ্লবী নন, তিনি ছিলেন এক দূরদ্রষ্টা রাষ্ট্রনেতা। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রবিপ্লব আমরা অনেক দেখেছি ও দেখছি। কিন্তু ক'জন নেতা বিপ্লবোত্তর-উদ্ভুত সমস্যার অনুপুঙ্খ অনুধ্যানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছেন বিপ্লবের পথে? ক'জন নেতাই বা নিজের স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে বলি দিয়ে দেশের স্বার্থকেই জীবনের একমাত্র ব্রত করে তুলেছেন?
সুভাষচন্দ্রের একটি স্বপ্নের ভারত ছিল। কলকাতায় মহাজাতি সদনের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে একদিন তিনি বলেছিলেন, "'যে স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়েছি তা' শুধু স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নয়। আমরা চাই ন্যায় ও সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন রাষ্ট্র – আমরা চাই এক নূতন সমাজ ও এক নূতন রাষ্ট্র, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম আদর্শগুলি।" আবার শুধুমাত্র নামসর্বস্ব রাজনৈতিক স্বাধীনতার মোহও তাঁর ছিল না। তিনি বিলক্ষণ জানতেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাহীন তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র বিদেশির হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই না। জাপান বা জার্মানির সাহায্য নেওয়ার সময়ও তাঁকে সদা সতর্ক থাকতে হয়েছিল, যাতে সেই সাহায্যের বিনিময়ে একদিন না ভারতের মাথা বিকিয়ে যায়। আজাদ হিন্দ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে জাপানের আর্থিক ঋণ শোধের উদ্যোগ সেই সতর্ক মনোভাবেরই বার্তাবহ। ভারতীয় অর্থনীতিতে সুভাষচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ দান পরিকল্পনার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। সোভিয়েত ধাঁচে ভারতে পরিকল্পনার অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে সুভাষচন্দ্রেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এই জন্য গান্ধীবাদী অর্থনীতিদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তাঁর পথই যে সঠিক ছিল, স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী।
যুদ্ধের ময়দানের সুভাষচন্দ্রের ব্যর্থতার কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানায়ক শাহনওয়াজ খান ফৌজের পরাজয়ের জন্য জাপানিদের দায়ী করেছেন। তাদের অহেতুক কালক্ষেপ এবং কিছুক্ষেত্রে ফৌজের প্রতি অবান্তর অনাস্থা ফৌজের গতিকে ব্যাহত করেছিল। জাপানের সহায়তা মুক্তহস্তের সহায়তা ছিল না, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে জাপানের পশ্চাদপসারণ। উপরন্তু কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা কেউই নেতাজির নীতিকে সমর্থন করেননি। কমিউনিস্টদের নেতাজি-বিরোধিতা তো রীতিমতো অশ্লীলতার পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছিল – আজও সেকথা বহুআলোচিত। কংগ্রেসও নেতাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদেরই নৈতিক সমর্থন জোগায়। তবে সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ব্রিটিশ বাহিনীর ক্রমাগত অপপ্রচার, সংবাদমাধ্যমের উপর কঠোর নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞার ফলে নেতাজি ও তাঁর বাহিনীর আদর্শ ও কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ অবহিত হতে পারেননি। যুদ্ধোদ্ভুত দেশের করুণ পরিস্থিতিও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তুমুল উদ্যোগে গণসংগ্রাম পরিচালনার প্রতিকূলে ছিল।
কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আপাত-পরাজয় যে আদৌ পরাজয় না তা টের পাওয়া যায় কিছুদিন পরেই। নেতাজির অন্তর্ধানের পর ('নেতাজির মৃত্যু' শব্দবন্ধটি বহু মিথ্যা ও রহস্যের দ্বারা আবৃত, তাই সেই শব্দবন্ধটি পরিহার করলাম) ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধবন্দী আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনানীদের বিচারের সভা বসায় দিল্লির লালকেল্লায়। শাহনওয়াজ খান, গুরুবকস সিং ধিলন, প্রেম সেহগল প্রমুখের বিরুদ্ধে আনা হয় রাজদ্রোহিতার অভিযোগ। কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকে তাঁদের মুক্তির দাবি ওঠে। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে ১৬০টি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে। কংগ্রেস কতকটা বাধ্য হয়েই গঠন করে আইএনএ ডিফেন্স কমিটি। জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই দেশাই, তেজবাহাদুর সপ্রু, কৈলাসনাথ কাটজু ও আসফ আলির মতো নেতাদের এগিয়ে আসতে হয় বাহিনীর সমর্থনে। যদিও ঐতিহাসিক নিমাইসাধন বসু মনে করেন, কংগ্রেস নেতাদের এহেন আচরণ ছিল নেতাজির জনপ্রিয়তাকে ভাঙিয়ে নির্বাচনী ফায়দা লোটার অভিসন্ধিপ্রসূত। সে যাই হোক, ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের দোষী সাব্যস্ত করলেও, শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতি নরম হতে বাধ্য হয়। আর নেতাজির কীর্তিকাহিনির যথাযথ খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভারতে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের নিরামিষ আন্দোলন তিন দশকের প্রচেষ্টায় যা করতে পারেনি, সুভাষচন্দ্রের তথাকথিত ব্যর্থ সামরিক অভিযান কয়েক মাসের মধ্যে তা করে দেখায়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন শাখাতেই ভারতীয় জওয়ানদের মধ্যে অভূতপূর্ব অসন্তোষ দানা বাঁধে। ১৯৪৬ সালে বোম্বাইয়ের নৌবিদ্রোহ প্রমাণ করে দেয়, জন-অসন্তোষ এবার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে তাকে ঠেকানোর উপায় নেই। ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর হাতে এত বড়ো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি ব্রিটিশদের। একথা বললে আদৌ অত্যুক্তি করা হবে না যে, স্বাধীনতার জন্য অসূর্যাস্ত-পশ্যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর যদি প্রকৃত কোনো চাপ কেউ দিয়ে থাকেন তবে তিনি একমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
সুভাষচন্দ্র বিরুদ্ধে কারো কারো অভিযোগ হিটলার ও মুসোলিনীর মতো নেতার সাহায্য গ্রহণ। একথা মনে রাখতে হবে, নেতাজি 'শত্রুর শত্রু পরম মিত্র' নীতির বশেই তাদের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। সেই অবস্থায় নেতাজির সামনে বিকল্পও কিছু ছিল না। কিন্তু সাহায্য প্রার্থনা করলেও নেতাজি নিজে কোনোদিন ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেননি। হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন সুভাষ। পছিলেন নাৎসীদের রোষনজরেও। কিন্তু ইতালি, জার্মানি বা জাপান কারোরই হাতের পুতুলে পরিণত হননি। তাঁর একমাত্র কারণ সুভাষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি। গীতায় বলেন, সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতের বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারংবার আবির্ভূত হন। দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয় তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের দেশনায়ক।" কবিগুরুর উচ্চারণ মিথ্যা হয়নি। তাঁর চরম বিরোধীও একদিন তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৩ জানুয়ারি গান্ধীজি তাঁকে 'প্রথম ভারতীয় ও শেষ ভারতীয়' বলে বর্ণনা করেন। আর ব্রিটিশ সরকার? ব্রিটিশ সরকারের একটি গোপন রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, "সুভাষচন্দ্র বসু হয়তো মারা গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কাজের অনেকটাই আজও বেঁচে আছে।"
Post a Comment