কচুরিপানার ওপর বাড়ি, হাজার বছর ভাসছে তারা


Odd বাংলা ডেস্ক: ভাসমান জনপদ আমাদের কাছে মোটেও অপরিচিত নয়। কারণ আমাদের দেশে বেদে সমাজ পানিতে নৌকার ওপর জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। তবে তারাও সবসময় পানিতে কাটায় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় তারা সমতলে উঠে আসে। বসতি গড়ে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন একটি জনপদ আছে যাদের সমগ্র জীবন কাটে পানির ওপর। জলের ওপরই জন্ম, জলের ওপরই মৃত্যু। এই জনগোষ্ঠীর নাম মার্শ আরাব। বাসস্থান ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল। মার্শ শব্দের অর্থ জলাভূমি। আরাব অর্থ 'আরবের অধিবাসী'। 

খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই স্থানটিতেই সুমেরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। বৃটিশ নৃতত্ত্ববীদদের মতে সুমেরীয় সভ্যতার পতনের পর তাদের অল্পসংখ্যক বংশধর কিংবা আরব জাতি এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে এই জাতীগোষ্ঠী মা’দান নামক আরব উপজাতীদের সঙ্গে মিশে মা’দান নামে পরিচিতি হয়। এই মা’দানরাই পরবর্তী সময়ে মার্শ আরাব নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। চারিদিকে ধু ধু মরুভূমির মধ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মিলনস্থলে মার্শ আরব উপজাতীর জনগোষ্ঠী প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে জল আর প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক আশ্চর্য জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এদের বাড়িগুলো তৈরি হয় নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ দিয়ে। বাড়িগুলোকে বলা হয় মুদিফ।

জলাভূমিতে জন্মানো নলখাগড়া থেকে তৈরি বাড়িগুলোতে কাঠ বা পেরেক ব্যবহার করা হয় না। প্রথমে মাটি এবং নলখাগড়া দিয়ে পানির ওপর দ্বীপ তৈরি করা হয়। বাড়িগুলো এই ভাসমান দ্বীপের ওপর বানানো হয়। দ্বীপগুলো যেন ভেসে না যায়, নিশ্চিত করতে নৌকার মতো নোঙর করে রাখা হয়। ফলে মার্শ আরব অধিবাসীদের এই জনপদ উপর থেকে দেখলে হাজার হাজার দ্বীপের সমষ্টি বলে মনে হয়। বাড়িগুলোর আরও কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। যেমন পুরো বাড়িটাই বহনযোগ্য, অর্থাৎ খুব সহজেই খুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়। ভালোভাবে যত্ন নিলে এরকম একেকটি বাড়ি প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। ধর্মীয়ভাবে মার্শ আরাবরা শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী। পেশাগতভাবে তারা কৃষিজীবী। মেষ পালন, জলাভূমিতে ধান চাষ, মৎস শিকার তাদের প্রধান পেশা। বর্তমানে তারা নলখাগড়া দিয়ে কার্পেট বুনে বিক্রিও করে। অর্থাৎ অতি সাদামাটা তাদের জীবনধারা। তবে এই সাদামাটা জীবনেও কালে কালে বহু আঘাত এসেছে। 

আরও পড়ুন-  বাড়ি কেনার প্ল্যান করছেন? মাত্র ৭১ টাকায় বিকোচ্ছে আলিশান বাড়ি, কোথায়

তবে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে সাবেক ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেনের আমলে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সাদ্দাম হোসেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে টাইগ্রিস নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেন। ধীরে ধীরে জলাধার শুকিয়ে ২০ হাজার বর্গ কি.মি. আয়তনের বিশাল জলরাশি পরিণত হয় মরুময় বালুচরে। ফলে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্শ আরাব জনগোষ্ঠী ঐ অঞ্চল ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কারণ জীবন-জীবিকা সব দিক থেকেই এরা ছিল জলাধারের উপর নির্ভরশীল। তবে ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে অঞ্চলটি পুনরায় জলমগ্ন হয়। এরপর ফিরতে শুরু করে পুরনো অধিবাসীরা। 

২০১৬ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া অঞ্চলটি ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আগের অধিবাসীরা ফিরে এসে মরুভূমির জলজ জীবনে পুনরায় প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমানে এই জলজ জনপদের বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় দশ হাজার।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.