মরিচঝাঁপি: জ্যোতি বসু বলেছিলেন, কেউ যেন খাবার ও পানিয় জল না পায়, পুলিশ দিচ্ছিল টহল


শুভেন্দু পাঠক: অধ্যায়টির নাম ‘মরিচঝাঁপি’। যে অধ্যায়টি সফলতার সাথে সমাপ্ত করা হয় ১৯৭৯ সালের ১৬ মে। যার শুরুটা ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি। ভারতের পবিত্র অখণ্ডতা ভঙ্গকারী, বিদেশী শক্তির দালাল হিসেবে উল্লেখ করে 'নিচু' শ্রেণির একদল মানুষকে উচ্ছেদ করার অভিযান চলে এ সময়টাতে। উচ্ছেদ অভিযান শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মানবতার পক্ষে কথা বলা বুদ্ধিজীবীরা। এর পেছনে রক্তারক্তি করান সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে সাজানো এক গ্রামকে, হত্যা করেন কারো ক্ষতি না করা নিরীহ মানুষদের। মরিচঝাঁপি মূলত একটি দ্বীপের নাম। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পরগণা জেলার একটি দ্বীপ এটি। সুন্দরবনের উত্তরভাগে অবস্থিত ১২৫ বর্গমাইলের একটি দ্বীপ মরিচঝাঁপি। যেখানকার অধিকাংশ জায়গা ছিলো শ্বাপদসংকুল। মানুষের বসবাসের অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে সেখানে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা দুরূহ কোনো কাজ ছিলো না। পরিষ্কার করে বসবাসের যোগ্য করার মতো এলাকা মরিচঝাঁপি। এটি সুন্দরবনের সুন্দরী, গড়ানের বনভূমি, যার এখানে-সেখানে নারকেল গাছ। এখানকার জমি জলকাদা আর শীর্ণকায় উদ্ভিদে ভরা।

২৪শে জানুয়ারি ১৯৭৯তে তখনকার সিপিএম সরকার অর্ডার দিয়েছিল মরিচঝাঁপিতে যেন কেউ খাবার বা পানিয় জল না পৌঁছায়। সেদিন থেকে পুলিশের ৩০টি লঞ্চ মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের পাহারা দিতে শুরু করে। এমন কি স্থানিয় মানুষদের বলা হয়েছিল উদ্বাস্তুদের যেন সাহায্য না করে তারা। 

প্রেক্ষাপট 


ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে ছিলেন, তখন থেকেই তারা এখানকার মানুষদের মনের ভেতর, চেতনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করেন। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ হয়। কাছের মানুষদের সাথে ভয়ানক লড়াইয়ের স্বাক্ষী হয় এখানকার মানুষজন। স্বাধীনতা পাওয়ার সময় ভাগ হয়ে যায় শান্তিকামী এই এলাকাটি। এর ফলে এপার বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে বহু বাঙালি শরণার্থী হিন্দু পরিবার তাদের প্রিয় আবাস ছেড়ে পাড়ি দেন পশ্চিমবঙ্গে। তাদের মধ্যে যারা উঁচুশ্রেণির এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা সহজেই আশ্রয় পান কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করা হয়।





কিন্তু বিপদে পড়ে যান নিচুশ্রেণির নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা। ভদ্রলোক বাঙালি উদ্বাস্তুদের কলোনিতে তাদের ঠাঁই হয় না। পরবর্তী সময়ে ‘দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট’ গড়ে উঠলে এদেরকে পাঠানো হয় বাংলা থেকে বহুদূরে দণ্ডকারণ্য, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যার মালকানগিরি এবং ভারতের ১৬৪টি দুর্গম প্রান্তে। এরা মূলত হতদরিদ্র কৃষিজীবী, কেউবা মুচি, কেউ কাজ করতেন দিনমজুর হিসেবে। মূলত সমাজের নিচু পেশা হিসেবে অভিধা দেওয়া পেশার সাথে জড়িত ছিলেন তারা। দণ্ডকারণ্যের পাথুরে জমি, শুকনো মাটি এবং অসহ্য খরায় তপ্ত বনভূমি বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও তাদের অনেককেই এমন সব পাহাড়ি এলাকায় ফেলে আসা হতো, যেখানে ছিলো হিংস্র সব প্রাণীর আনাগোনা। সেখানে থাকতো না সুপেয় জলের ব্যবস্থা। মারা পড়েছেন সেখানকার অনেক বাসিন্দা। এসব মরদেহ ট্রাক দিয়ে নিয়ে ফেলে দেয়া হতো। এই অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বিনোদ মজুমদার নামের একজন পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “১৯৬৪ এ যখন মানা ক্যাম্পে আসি, একটু জল ছিলো না। সকাল বেলা পানির কলের গোড়ায় কম করে হলেও ৫-৬ টা মার্ডার হয়েছে এক মগ জলের জন্য।” সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে বেশ কিছু পরিবার কুমিরমারি নামক এলাকা পেরিয়ে প্রথম জনবসতি হিসেবে আশ্রয় নেন মরিচঝাঁপিতে। এর অনেক আগ থেকেই দেশভাগের পর তাদের অধিকার নিয়ে বেশ জোরালো আওয়াজ তোলেন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলগুলো। এই দলের বুদ্ধিজীবীরা তখন ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারি জমি দখল করে এসব উদ্বাস্তু শরণার্থীদের জন্য বস্তি নির্মাণের পক্ষে আন্দোলন করছেন। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের নেতা জ্যোতি বসুসহ (১৯১৪-২০১০) আরও অনেক নেতা সরকারের নিকট চিঠি দিচ্ছেন। এসব শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গেই রাখার জন্য তাদের আকুতি। তারা জোর আবেদন জানান যে, সরকারের অভিপ্রায় থাকলে এটি সম্ভব।

(ধারাবাহিক)
পরের পর্বটি পড়তে আজই সাবস্ক্রাইব করুন oddbangla.com
Blogger দ্বারা পরিচালিত.