রামচন্দ্র চাটুজ্যে: বেলুনে চড়ে আকাশ ছোঁয়া ভারতের প্রথম বৈমানিক এক বাঙালি


Odd বাংলা ডেস্ক: এখন কলকাতার যেখানে নারকেলডাঙা, সেখানকারই এক মাঠে সেদিন প্রচুর মানুষ হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই। এক বাঙালি ছোঁকরা নাকি বেলুনে চড়ে আকাশে উড়বে। অনেকে হাসছে। মেয়ে বউরা তো আবার শঙ্খ-ঘন্টা সব নিয়ে প্রস্তুত। আকাশে উড়লে সবাই মিলে উলু ধনি দিয়ে উঠবে। বিরাট ব্যাপার। নিন্দুকেরা বলছে অত সহজ নয়! বিদেশে হয়েছে। এখানকার হাওয়ার রকম সকম ভালো নয়। বেলুন উড়বে কিনা দেখো। গ্যাস ভরা হচ্ছে ফানুসে। ফানুসের নিচের দিকে একটি ইস্পাতের আংটা। সেই আংটা থেকে ১২ ফুট নিচে ঝুলছে প্রকাণ্ড এক ঝুড়ি। এই ঝুড়িতে চেপেই নাকি এক বাঙালি উড়বে আকাশে!

ফানুসে গ্যাস ভরা হলো, ঝুড়ির চারদিকে বালির থলেও ঝুলল, আর সেইসাথে অবসান ঘটল সমবেত জনতার প্রতীক্ষার। সাদা রঙের আঁটো জ্যাকেট আর বেগুনি ট্রাউজার পরে, গলায় দূরবীন ঝুলিয়ে পুরোদস্তুর সাহেবি মেজাজে দর্শকদের মাঝে হাজির হলেন আকাঙ্ক্ষিত সেই বাঙালি বাবু। ঝুড়িতে চড়লেন ভদ্রলোক। কিছুক্ষণ বাদেই ঝুড়িসমেত মানুষটিকে নিয়ে ফানুসটি তরতর করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল। জনসমুদ্রে তখন উল্লাসের জোয়ার! সেই প্রথম কোনো বঙ্গতনয় তথা ভারতীয় এককভাবে আকাশে উড়ল, সৃষ্টি করল নতুন দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী, রোমাঞ্চপ্রেমী মানুষটির নাম রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


বেলুনে চড়ে আকাশে ওড়া বিষয়টি আসলে বিদেশেই প্রথম তৈরি হয়। এবং ইংরেজরা খেলা দেখাতে থাকেন। সেই সময় এমনই এক সাবেন জি. স্পেনসার আসেন কলকাতায় খেলা দেখাতে। রেসকোর্সের ময়দানে সেদিন স্পেনসার তাঁর বেলুন ওড়ান। ব্যাস সেদিন দর্শকদের মধ্যে হাজির ছিলেন রামচন্দ্র চাটুজ্যে। তিনিও বাড়ি ফিরে শুরু করে দেন বেলুনিং।     

রামচন্দ্র ছোট থেকেই দুঃসাহসিক সন কাজ করতেন। মানে আমরা এখন যেটাকে স্টান্ট বলি। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল নবগোপাল মিত্রের ন্যাশনাল সার্কাসে ফ্লাইং ট্রাপিজ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি গ্রেট ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান সার্কাসের পরিচালকের পদ অলংকৃত করেন। এছাড়া গভর্নমেন্ট নর্মাল স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুকাল। স্পেন্সার সাহেবকে ৫০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে রামচন্দ্র বেলুনিং-এর বিলেতি বিদ্যে রপ্ত করেন। স্পন্সর হিসেবে পেয়ে যান পাথুরিয়াঘাটার জমিদার গোপালচন্দ্র মুখার্জিকে। প্রথম শো'র দিনও ঠিক হয়ে যায় ঝটপট। অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০ এপ্রিল বঙ্গসন্তান রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বেলুন ওড়ে আকাশে। অবশ্য তিনি একাই নন, শিষ্য রামচন্দ্রের সাথে তার সাহেব গুরুও অবশ্য সেবার চড়েছিলেন বেলুনে। তবুও এই বেলুন বিহারটির ইতিহাস রামচন্দ্র বা ভারতবাসীর জন্যে ছিল বিশেষ! কেননা, এর আগে কোনো ভারতীয়ই বেলুনে চড়ে আকাশ ছোঁননি।

প্রথমবারের সফলতার পর আমাদের বাবু বেলুনবিদ, রামচন্দ্র ২৭ এপ্রিল তার একক প্রদর্শনী করবেন বলে ঘোষণা দেন। স্পেন্সার সাহেবের 'দ্য ভাইসরয়' বেলুনটি কিনে তার নতুন নাম দেন 'দ্য সিটি অভ ক্যালকাটা'। নির্ধারিত দিনে গ্যাস কোম্পানির মাঠে তো তিল ধারণের জায়গা নেই! কিন্তু আকস্মিক ঝোড়ো হাওয়া দিল সব ভণ্ডুল করে। উড়বার জন্য প্রস্তুত বেলুনের গ্যাস দিতে হলো বের করে। যদিও আবহাওয়া একটু স্বাভাবিক হলে রামচন্দ্র খেলা দেখাতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্পেন্সার সাহেব অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে নিরস্ত করেন। ঠিক হলো মে মাসের চার তারিখে রামচন্দ্র অবশ্যই খেলা দেখাবেন। হলোও তা-ই। সেদিন আর কাউকে নিরাশ হতে হয়নি। হাজার আটেক দর্শকের সাথে গ্যাস কোম্পানির মাঠে সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পুলিশ কমিশনার ও বেশ কিছু বিজ্ঞানমনস্ক গণ্যমান্য ব্যক্তি। সবাই তো হতবাক! বেলুনটি বিকেল পাঁচটা দশ মিনিট থেকে টানা ৪০ মিনিট শূন্যে অবস্থান করে সোদপুরের কাছে নাটাগড় নামক গ্রামে অবতরণ করে। লেখার শুরুতে এই ভ্রমণের আভাসই দেওয়া হয়েছে। এরপর রামচন্দ্রকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য ও নেটিভ স্টেট থেকে তিনি আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন। হয়ে উঠলেন ভারতবর্ষের প্রথম পেশাদার বেলুনবিদ। তবে ২৭ জুন এলাহাবাদের খুশেরাবাগে তিনি যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন, তা তার অন্য সকল অর্জনকে ছাপিয়ে যায়। অপর্যাপ্ত গ্যাস অথবা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের কারণে সেবার আর তার বেলুন ভাসছিল না। তখন রামচন্দ্র বালুর বোঝাসমেত গোটা ঝুড়িটাকেই খুলে ফেললেন বেলুন থেকে। ইস্পাতের আংটার ওপর বসেই দেখালেন তার ক্যারিশমা, প্রমাণ দিলেন তার নিশ্ছিদ্র পেশাদারি দক্ষতার। 
সেই সময়ের ইংরাজি দৈনিকে প্রকাশিত রামচন্দ্র চ্যাটার্জীকে নিয়ে লেখা আর্টিকাল


পরবর্তীতে রামচন্দ্র প্যারাশ্যুটের সুবিধাযুক্ত একটি নতুন বেলুন সংগ্রহ করেন এবং যথাক্রমে দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, ইন্দোর, আগ্রা ও বেনারসে তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। অবশেষে কোনো একটি নেটিভ স্টেটের পাহাড়ের ওপর প্যারাশ্যুট ল্যান্ডিং করার সময় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। সেখান থেকে তাকে জীবিত অবস্থায় কলকাতা আনা হলেও শেষরক্ষা করা যায়নি। গোপাল মুখার্জির বাগানবাড়িতে এই মহান অভিযাত্রী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তারিখটা ১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.