শুধুই জালিয়ানওয়ালাবাগ নয়, জানুন ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহের কথা
Odd বাংলা ডেস্ক: আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ১৯১৯ সালের ২৪ এপ্রিল। এর তিন বছর পরেই ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ। এর তিনদিন আগে সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা হাটে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পাশের ফুলঝোর নদীতে ফেলে দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা।
১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর ভারতের গোরক্ষপুর জেলায় চৌরিচৌরার ‘অসহযোগ’ আন্দোলনকারী জনতা একটি থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে ২৩ জন পুলিশ ও তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। ‘অহিংস ও অসহযোগ’ আন্দোলন ক্রমেই সহিংস হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে, ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের সময়কে ‘গান্ধী যুগ’ বলে অভিহিত হলেও, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাকেও অনেকে গান্ধী যুগে ফেলেন। চৌরিচৌরার ঘটনার ৮দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। অথচ সেটি ছিল সদ্য সমাপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর্যুদস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আঘাত হানার সবচেয়ে অনুকুল সময়।
ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহে সাড়ে চার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছিল বলে ব্রিটিশ সরকার স্বীকার করেছিল। তবে কায়দা করে নিহতের সংখ্যা এড়িয়ে গিয়েছিল তারা। প্রতক্ষ্যদর্শীরা নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজার বলে দাবি করে। সলঙ্গা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কংগ্রেসের তরুণকর্মী আব্দুর রশিদ, পরবর্তী সময়ে যিনি তর্কবাগিশ খেতাবে অভিহিত হন। আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং পরে গণ আজাদী লীগ গড়ে তোলেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন পাস হলে, ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল সেই আইন বলবৎ করে। এই আইনবলে ভারতবাসীর উপর দমনমূলক নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়, ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যাতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেফতার, জেল জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়।
এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত অনেক ভারতবাসীকেই ক্ষুব্ধ করে। এরই মধ্যে তুরস্কের মুস্তাফা কামাল ইসলামের খলিফা বলে পরিচিত তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করেন। তখন লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে মুসলমান নেতারা খিলাফত কমিটি গঠন করে তাঁদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসিন্যের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন।
গান্ধী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। সকল অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়দের সরকারি স্কুল, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরি ত্যাগে উৎসাহিত করা হয়। আইনজ্ঞরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। গণ-পরিবহন, ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত কাপড় বর্জিত হয়।
মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মুখতার আহমেদ আনসারী, হাকিম আজমল খান, আব্বাস তয়েবজি, মওলানা মহম্মদ আলি ও মওলানা শওকত আলী প্রমুখ মুসলিম নেতারা গান্ধীকে সমর্থন করেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীও খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে। তখনই হিন্দু মুসলিমের মধ্যে একটি ঐক্যের সুর বেজে ওঠে।
অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর্যুদস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। মোহনদাস করমচাদ গান্ধী আন্দোলনের তেজ দেখে ভীত হয়ে পড়েন। এত বড় রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরও তিনি আসেননি সলঙ্গায়। তিনি কি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন- জানা নাই। জনতার জাগরণ দেখে সে যুগে শুধু ইংরেজ নয় হিন্দু মুসলিম নেতৃত্বও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।
অসহযোগ ও খেলাফতের যুগ্ম আন্দোলনের ব্যর্থতা দেশীয় হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলনে ছেদ ঘটায়। দুই সম্প্রদায় পুনরায় ফিরে যায় বিভেদের পথে। ফলাফল, তরুণ আবদুর রশিদ তৎকালীন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের পথে পা বাড়ান। বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত জনতাকে প্রতিহত করতে সেদিন ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বাহিনীর সমুদয় গোলা বারুদ খরচ হয়ে যায়। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ৪০ জন আর্মড পুলিশের মধ্যে ৩৯ জনেরই আর কোনো গুলি অবশিষ্ট ছিল না।
সলঙ্গা বিদ্রোহ সম্পর্কে আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশের ভাষ্য, ‘অবিরাম গুলি বর্ষণে আর্মড পুলিশের সব গুলি শেষ হয়ে যায়। এ খবর মুহূর্তে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, মার খাওয়া জনতা ফালা, লাঠি, সরকি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের চারদিক ঘিরে ফেলে এবং সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাথায় আত্মরক্ষার্থে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে মুক্ত করে দিয়ে অনুরোধ করেন, ‘আপনি যেমন করেই হোক জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করুন এবং ফিরিয়ে নিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুরোধ আমি গ্রহণ করলাম। কারণ অহিংস আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্বও ছিল।’
‘জনতার মধ্যে জোর গুজব রটে গিয়েছিল আমাকে হত্যা করা হয়েছে। এ গুজবই তাদের আরো মারমুখী ও উত্তেজিত করে তুলেছিল। হত্যা করা না হলেও আমাকে জখম করা হযেছিল মারাত্মকভাবে। ডান হাতের কব্জি থেকে তালু পর্যন্ত সঙ্গীনের খোঁচায় রক্তপাত হচ্ছিল। কখন কীভাবে যে এ আঘাত লেগেছে তা বুঝতেই পারিনি।’
‘যাক আমি যে জীবিত আছি, তা দেখে জনতা কিছুটা আশ্বস্ত হয় বটে, কিন্তু যে বর্বর হত্যাকাণ্ড আর্মড পুলিশ ঘটিয়েছে, তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তখন জনগণকে শান্ত করে যারা বাংলার মাটিতে এমন পাশবিক কাজ ঘটিয়েছে তাদেরই রক্ষা করতে হলো। যতদূর মনে পড়ে বলেছিলাম, এখন আপনারা যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরো পুলিশ আসবে, গোরা সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে।’
এ কথা শোনার পর জনগণের ভেতর থেকে একটি বিক্ষুব্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো, তাহলে গান্ধী রাজারে খবর দেন, সেও তার সৈন্য পাঠাক। উত্তরে বললাম, গান্ধী রাজার সৈন্য তো আমরাই। অন্য সৈন্য গান্ধী পাবেন কোথায়? তখন ভিড়ের মধ্যে শত কণ্ঠে প্রশ্ন এলো, তাহলে ঐ পঁচা ভেড়ার লেজ ধরেছেন কেন? ব্রিটিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে বিক্ষুব্ধ জনতার এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। তাই অনেক বুঝিয়ে অনুরোধ করে অবশেষে বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েও সেদিন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ সুপার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ ৪০ জন পুলিশের প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল অহিংস অসহযোগের প্রতি আমাদের নিষ্ঠা ও অবিচল আস্থার দরুণ।’
এই আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে ১৯৪৭ সালের বহু আগেই তা ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে সক্ষম হতো। সমঝোতা ছাড়াই উদিত হতে পারত ভারতের স্বাধীনতার সূর্য।
Post a Comment