শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দিন পাগল ভেবেছিলেন বিবেকানন্দ, জানুন সেই অজানা কাহিনি


বিক্রম পাঠক, Odd বাংলা: ১৮৮১ পৌষ মাস, অর্থাৎ ডিসেম্বর-এর শেষ, নরেনের বয়স তখন সবে ১৮ । ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথায় (ভাষা লেখক স্বামী সারদানন্দ কর্তৃক মার্জিত) শুনুন, " পশ্চিমের (গঙ্গার দিক) দরজা দিয়ে নরেন্দ্র প্রথম দিন এই ঘরে, ঢুকেছিলো।  দেখলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নেই, মাথার চুল ও শরীরের বেশভূষার  পারিপাট্য নেই।  বাইরের কোনো পদার্থেই ইতর - সাধারণের মতো একটা আঁট নাই। সবই যেন তার আলগা, এবং চোখ দেখে মনে হলো, তার মনের অনেকটা ভেতরের দিকে কে যেন সর্বদা টেনে রেখেছে। দেখে মনে হল, বিষয়ী লোকের আবাস এই কলকাতা, এখানে এতবড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব ?গান গাইবার কথা জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাংলা গান সে দুচারটি মাত্র শিখেছে, তাকে গাইতে বললাম।

এর পরে, নরেন কি বলছেন শুনুন, - গান তো গাইলাম, তারপরেই ঠাকুর উঠে আমার হাত ধরে, তার ঘরের উত্তরে যে বারান্দা আছে, সেখানে নিয়ে গেলেন। শীতকাল, উত্তরের হাওয়া নিবারণের জন্য, বারান্দাটি ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা ছিলো, সুতরাং ভিতরে ঢুকে ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিলে, ঘরের ভিতরের বা বাইরের কোনো লোককে দেখতে পাওয়া যেত  না। বারান্দায় ঢুকে, ঠাকুর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, ভাবলাম, আমাকে বুঝি  নির্জনে কিছু উপদেশ  দেবেন। কিন্তু যা বললেন, ও করলেন, তা আমার কল্পনার অতীত। সহসা আমার হাত ধরে, দরদরিতধারে, আনন্দ অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। এবং পূর্ব পরিচিতের ন্যায় পরম স্নেহে বললেন : এতদিন পরে আসতে হয় ? আমি তোমার জন্য কিভাবে প্রতীক্ষায় রয়েছি, তা একবার ভাবতে নেই ? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম হয়েছে। প্রাণের কথা কাউকে না বলতে পেরে, আমার পেট ফুলে রয়েছে - ইত্যাদি অনেক কথা বললেন, ও কাঁদতে লাগলেন। এর পরেই, আবার আমার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে, দেবতার মতো আমাকে সম্মোধন করে বলতে লাগলেন, জানি আমি প্রভু, তুমি সেই সনাতন ঋষি নবরূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করতে, পুনরায় শরীর ধারণ করেছো। .......ইত্যাদি ইত্যাদি। .
স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন,  আমিতো তার এই আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কাকে দেখতে এসেছি ? এতো একেবারে উন্মাদ। নাহলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এই সব কথা বলে ?...... যাইহোক,  খানিক্ষন পরে, ঘর থেকে বেরিয়ে মাখন, মিছরি ও কয়েকটা সন্দেশ এনে, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন।  আমি যত বলি, খাবারগুলো আমাকে দিন, আমি সঙ্গীদের সাথে ভাগ করে খাইগে, তিনি আমার কথা শুনলেন  না। ওরা  খাবেখন, তুমি খাও। বলে সব খাবার আমাকে খাইয়ে তবে নিস্তার।

দক্ষিনেশ্বর-এ  দ্বিতীয় দিন :
বিবেকানন্দ বলছেন, জিজ্ঞেস করতে করতে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম এবং একেবারে ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, তিনি ছোট খাটখানির উপরে, একাকী বসে আছেন।  নিকটে কেউ নেই। আমাকে দেখা মাত্র সাহ্লাদে নিকটে ডেকে,খাটের একপ্রান্তে এসে বসলেন।বসবার পরেই তিনি যেন কেমন ভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন।  এবং অস্পষ্টস্বরে নিজে নিজে কি বলতে বলতে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ করে ধীরে ধীরে আমার দিকে সরে আসতে  লাগলেন।  বিবেকানন্দ বলছেন, ভাবলাম পাগল বুঝি আগের দিনের মতো আবার পাগলামি করবে।  এই ভাবতে ভাবতে তিনি সহসা আমার নিকটে এসে  নিজের ডান পা আমার অঙ্গে স্থাপন করলেন। সেই স্পর্শে, মুহূর্তের মধ্যে আমার এক অপূর্ব উপলব্ধি উপস্থিত হলো। চেয়ে দেখলাম দেয়ালগুলোর সাথে ঘরের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় লিন হয়ে  যাচ্ছে। সমস্ত বিশ্বের সাথে আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহা শুন্যে একাকার হতে ছুটে চলেছে। তখন দারুন আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হল , আমিত্বের নাশেই মরণ। সেই মরন আমার সামনে, অতি নিকটে। সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম। ওগো তুমি আমার এ কি করলে ? আমার যে বাপ্-মা আছেন।  বিবেকানন্দ বলছেন, অদ্ভুত পাগল আমার এই কথা শুনে, খিল খিল করে হেসে উঠলেন। এবং হাত দিয়ে আমার বুক স্পর্শ করতে করতে বললেন, তবে এখন থাক, একবারে কাজ নেই, কালে হবে।  আশ্চর্য্যের বিষয়, তিনি এইভাবে স্পর্শ করে ঐ কথা বলামাত্র আমার সেই অপূর্ব প্রত্যক্ষ একেবারে চলে গেলো। আমি প্রকৃতিস্থ হলাম। ঘরের ভেতরের  ও বাইরের সব জিনিষকে আবার আগের মতো অবস্থিত দেখতে পেলাম ।

একেই বলে জাগতিক অথচ অলৌকিক দীক্ষা। ভালোবাসা প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ।আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সমস্ত বিশ্বে নিজেকে প্রতিভাত করেছেন। ভারতবাসীকে জগৎসভায় উচ্চ স্থান করে দিয়েছেন। শিবজ্ঞানে জীব সেবায় লক্ষ লক্ষ লোককে উদ্বুদ্ধ করেছেন।  আজ সেই ধারা সামনে চলছে।

কিন্তু বিবেকানন্দ কি ভেবেছিলেন বা তখন কি চিন্তা করেছিলেন, শুনুন - স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি হলো ? নিজেই দেখলাম তো, এই অদ্ভুত দর্শন,  এই অদ্ভুত পুরুষের প্রভাবে একবার সহসা উপস্থিত হলো, আবার সহসা লয়  হয়ে গেলো। মেসমেরিজিম বা মোহিনী বিদ্যা এবং হিপ্নোটিজম বা সন্মোহন বিদ্যা সন্মন্ধে পড়েছি। ভাবতে লাগলাম, এটা কি সেই রকম একটা কিছু ? কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। কারন দুর্বলচিত্তর  মানুষের উপরেই এইসব বিদ্যা প্রয়োগ করা যায়। আমি তো দুর্বল নোই।  আমি তো বুদ্ধিমান, মানসিক বলসম্পন্ন।  সাধারণ মানুষেরা গুণশালী পুরুষের সঙ্গলাভে মোহিত হয়, এবং তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, আমি তো তা নোই।  বরং প্রথম থেকেই এঁকে অর্ধউন্মাদ বলেই নিশ্চিত করেছি।  তাহলে এমনটি হবার কারন কি ? কিছুই ভেবে স্থির করতে পারলাম না। মনের মধ্যে প্রাণের মধ্যে একটা গোল বেঁধে রইলো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলাম, ভবিষ্যতে যেন আমার মনের উপরে, এই অদ্ভুত পাগল যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আবার ও ভাবলাম, ইচ্ছা মাত্রই এই পুরুষ যদি আমার মতো প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মানুষকে ভেঙেচুরে কাঁদার তালের মতো নিজের ভাবে ভাবিত করতে পারে, তবে এঁকে পাগলই বা বলি কি করে ?

তাহলে বুঝুন, বিশ্বনাথের শ্রেষ্ট সন্তান, যারা জন্ম নেন লোকশিক্ষার জন্য, তার মনেই গুরু সম্পর্কে সন্দেহ। ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে চেনা কত শক্ত।  তো শঙ্করাচার্য যে বলছেন, গুরু হবে ব্রহ্মজ্ঞানী।  তাকে চেনা আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে কত শক্ত।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.