ভারতীয়রা কি শুধু স্বার্থই দেখলেন! আর নেতাজির দর্শনের কী হল?
Odd বাংলা ডেস্ক: স্বাধীনতার আগে থেকেই সুভাষচন্দ্র বিষয়ে ভারতীয়দের মত একেবারে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল। জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের খুব কম বিষয়ে মতৈক্য, বিশেষত জাতীয়তা-স্বাধীনতার প্রশ্নগুলিতে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা সমস্বর: ইনি আস্ত কুইসলিং, তোজোর কুকুর। নরওয়ে-তে ভিদকুন কুইসলিং যেমন অক্ষশক্তির আক্রমণের সুযোগে তাদেরই সহায়তায় দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সুভাষও জার্মান কিংবা জাপানি বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের দিকে এগোচ্ছেন নিজে ক্ষমতার শীর্ষে বসবেন বলে: নেতৃমহল থেকে উৎসারিত ছিছিক্কার নিচুমহলের রাজনীতিতেও যথেষ্ট ছড়াল। স্বাধীন ভারতেও সরাসরি বামে দক্ষিণে নেমে এল এই উত্তরাধিকার, বিশেষত বাঙালি সমাজে। এখনও পর্যন্ত শিক্ষিত বুদ্ধিমান বাঙালির পক্ষে নেতাজিকে হেয় না করে কথা বলাটা চূড়ান্ত আনফ্যাশনেব্ল।
উল্টো দিকে অনেকের কাছেই নেতাজি এক নম্বর হিরো, কেননা 'যে কোনও উপায়ে' একমাত্র তিনিই ব্রিটিশকে শায়েস্তা করতে পারেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরির সময় গ্রামে-গঞ্জে রেডিয়োয় কান পেতে থাকত বড়রা, আর ছোটদের বইয়ের ভাঁজে, ড্রয়ারের কোণে, এমনকী ফটো-স্ট্যান্ডে সৌম্য রবীন্দ্র-মুখের পিছনে লুকোনো থাকত কাগজ-কাটা নেতাজি-মুখ! আশাময়তার এমন ঘূর্ণিপাক আমরা আজ কল্পনাও করতে পারি না, তবে বুঝতে পারি 'ক্ষমতার হিসেব' কিংবা 'ফ্যাসিবিরোধী রাজনীতির বিচ্যুতি', এ সব জন-আবেগের মধ্যে মোটেও জায়গা পায়নি। রাজনীতির জগৎ যতই নেতাজি ও তাঁর পথকে ব্রাত্য করে দিল, সাধারণ সমাজ ততই তাঁকে ঘিরে উন্মথিত হয়ে উঠল। এই প্রবল দ্বিখণ্ডিত পরিচিতিতেই নেতাজিকে পেল উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত।
আবেগপ্রাবল্যে অনেক সময় অনেক ভাবনা হারিয়ে যেতে বসে। পর পর এই দুইটি হাতে-গরম বই তেমন কয়েকটা ভাবনা ফিরিয়ে আনে। যেমন, নেতাজির বিদেশি সহায়তা-ভিক্ষার তথ্য থেকে নতুন করে ভাবা যায় তাঁর রাষ্ট্রসম্পর্ক চিন্তার ধরনটা নিয়ে। বাস্তবে যদি সে দিন নেতাজি জাপানি বাহিনী নিয়ে পৌঁছতেন ভারতের মূল ভূখণ্ডে, কী হত? জাপানিরা জিতলে, এ দেশ কি জাপানি উপনিবেশ হয়ে পড়ত? কাগজে-কলমে এ সম্ভাবনা ছিল কম, হিটলার নাকি মনে করতেন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শেষ হলে আর কোনও সাম্রাজ্যই হালে পানি পাবে না। তা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান যে অঞ্চল উপনিবেশ-মুক্ত করেছিল, সেগুলির কোনওটিতেই তারা নিজেরা উপনিবেশ গেড়ে বসেনি। তবে কিনা, ভারতের মতো আকর্ষণীয় জমি বিষয়ে তারা কি উদাসীন থাকতে পারত? সে দিনের প্রেক্ষিতে নেতাজির আশার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু আরও একটি গুরুতর প্রশ্ন ওঠে: নেতাজির নৈতিকতা নিয়ে, সুবিধাবাদী রাজনীতির ঘরানা নিয়ে।
এই দ্বিতীয় প্রশ্নটি কিন্তু এ বার 'অতীত' হয়ে যাওয়ার সময় এসেছে, একুশ শতকের ভারতে। সি পি আই এম যেমন নেতাজি বিষয়ে তাদের এতকালের অচ্ছুতপনার পাপক্ষালন সেরে ফেলেছে, তেমনই সমগ্র ভারতীয় রাষ্ট্রও একটা ভ্রম-সংশোধন করতে পারে এ বার। এ দেশে 'রিয়্যালিস্ট' বা বাস্তববাদী কূটনীতির নতুন ধারা যে ভাবে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে, নৈতিকতার বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে স্বার্থ-নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদর্শ বিকশিত হচ্ছে, তাতে আর এই সংশয় কি পাঠ্যবইয়েও উঁকি দিতে পারে যে, নেতাজি ভ্রষ্ট পথে বিচরণ করছিলেন? স্বাধীন ভারতে এই পথের নিশানা প্রথম এসেছিল ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের পর। নেহরুর অত্যধিক আদর্শতাড়িত বিদেশনীতিই দেশকে বিপদের সামনে ছুঁড়ে ফেলেছিল, এই আত্মধিক্কার থেকে। অর্ধশতক পর সেই নীতি আজ প্রত্যয়ী পূর্ণকলায় বিকশিত। যে যুক্তিতে আজ নয়াদিল্লি মায়ানমারে সামরিক শাসনের অত্যাচার অবজ্ঞা করে জুণ্টা সরকারের সঙ্গে মিত্রভাব বজায় রাখে, যে যুক্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের লেকচার অগ্রাহ্য করে ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মিত্রতায় টোল পড়তে দেয় না, যে যুক্তিতে সিরিয়ার একনায়ক গোটা জাতিকে মেরে-পিটিয়ে জাহান্নমে পাঠিয়ে দিলেও ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাল্টা-মারে নামতে অস্বীকার করে— সুভাষচন্দ্র তো সেই যুক্তিই দিয়েছিলেন। জার্মানি বা ইতালির অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি বিষয়ে তিনি সহানুভূতি-পরায়ণ তো ছিলেনই না, তা নিয়ে তাঁর বিশেষ হেলদোলও ছিল না। কেবল পরাধীন ভারতের স্বার্থের প্রিজম্ দিয়ে তিনি দেখছিলেন সম্পর্কগুলিকে: শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, এই কৌটিল্য-মতে আস্থা রাখছিলেন। ব্রিটেন আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়ন সকলেই রেখেছিল বিশ শতকের কোনও না কোনও পর্বে!
স্বার্থচালিত পথই কি কূটনীতির সেরা পথ? তর্ক উঠুক। কিন্তু নেতাজির স্বার্থ-যুক্তির বিরুদ্ধে যে নৈতিকতার যুক্তি, তা দিতে পারত নেহরুর ভারত, নেহরু-উত্তর ভারতের আর সেই অধিকার নেই। বরং স্বীকার করা হোক, দেশের জাতীয় সংগীত কিংবা জাতীয় প্রতীক যেমন নেতাজির ভাবনা থেকেই আহরিত হয়েছে, আমাদের বর্তমান কূটনীতিও তাঁরই পরোক্ষ দান!
Post a Comment