ইয়েতি: তুষারমানবদের দেখা গেলেও বিজ্ঞান তার অস্তিত্ব স্বীকার করে না কেন?
Odd বাংলা ডেস্ক: হাজার বছর ধরে হিমালয় অঞ্চলে ইয়েতি নামের এক দানবীয় প্রাণীর উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ইয়েতি বিশাল আকৃতির, সারা শরীর সাদা অথবা বাদামী লোমে ঢাকা এবং ইয়েতি নিয়ে নানা কাহিনী, তথ্য এবং প্রমাণ বিভিন্ন সময় হাজির করা হয়েছে। কথিত আছে ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডারও রহস্যময় ইয়েতির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মনে করা হয়, হিমালয় পর্বতমালার তুষার এবং বরফের রাজ্যে বসবাস করা মানুষের মতো দু’পেয়ে কিন্তু আরো বড়ো এক প্রাণীই হচ্ছে 'ইয়েতি'। একসময় তিব্বত, ভূটান, ভারত এবং নেপালের স্থানীয় অনেক গোত্রে ইয়েতিকে শিকারের দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। ইয়েতির রক্ত জাদুবিদ্যা বা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতারও অংশ বলে মনে করা হতো।
‘ইয়েতি’ নামটা এসেছে তিব্বতি ভাষা থেকে যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পাথুরে ভল্লুক’! হিমালয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের বিশ্বাস ছিলো ইয়েতিরা বিশাল সব পাথর খন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতো যা দিয়ে তারা আত্মরক্ষ্মা নয়তো শিকার করতো। যে কারণে এদের নাম হয়ে যায় ইয়েতি বা পাথুরে ভল্লুক। তবে এদের ভিন্ন ভিন্ন নামেও ডাকা হয় যেমন- ‘মেহ-তেহ’, যার মানে হলো মানুষ-ভল্লুক! ‘মি-গো’, মানে বনমানুষ! ‘ক্যাং আদমি’ বা 'তুষারমানব', মিরকা বা আদিম মানুষ ‘জোব্রান’ বা 'মানুষখেকো' ইত্যাদি।
কিংবদন্তীর এই প্রাণীটি আছে কি নেই তা নিয়ে গবেষণা, তর্ক-বিতর্ক আর জল্পনা-কল্পনা করা হয়েছে বিস্তর। বছরের পর বছর ধরে তুষারে বড় বড় পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া থেকে শুরু করে স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার মতো অনেক ঘটনাই বিজ্ঞানীদের প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
১৮৩২ সালে ব্রায়ান হজসন নামে এক অভিযাত্রী তার লেখা এক বই এ বলেছেন, নেপালের হিমালয় পর্বতমালায় অভিযান চালানোর সময় তার গাইডরা নাকি ঘন লোমে ঢাকা বিশালাকার এক অদ্ভূত দু’পেয়ে জন্তু দেখতে পেয়েছিলো। তবে ওটা ইয়েতি না হয়ে ওরাংওটাং-ও হতে পারে বলে লিখেছেন হজসন।
১৮৯৯ সালে লরেন্স ওয়াডেল নামে আরেক অভিযাত্রীর লেখা বই থেকে জানা যায় ইয়েতির পায়ের ছাপের কথা। তার গাইডরা তুষারের বুকে বড় বড় পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলো। তারা নিশ্চিত ছিলো ওগুলো ছিলো তুষারমানবের পায়ের ছাপ। কিন্তু তিনি ইয়েতির বদলে ওগুলো ভাল্লুকের পায়ের ছাপ বলেই ভেবেছিলেন।
২০ শতকের শুরুর দিকে যখন হিমালয় অঞ্চল অনুসন্ধানে অনেক অভিযান পরিচালিত হচ্ছিলো তখন এই ইয়েতিদের পায়ের ছাপ বা খোদ ইয়েতিদের দেখতে পাওয়ার নানা ঘটনা ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। ১৯২১ সালে কর্নেল সি কক হাওয়ার্ড বেরির নেতৃত্বে এভারেস্ট অভিযানে যায় একদল অভিযাত্রী। প্রায় ২০ হাজার ফুট ওপরে একটি হিমবাহের কাছে কয়েকটি বিশাল আকৃতির মানুষের পায়ের ছাপের মতো পদচিহ্ন দেখতে পান তারা। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী মেজর অ্যালান ক্যামেরুন মাউন্ট এভারেস্টে অভিযান চালানোর সময় একদল মানবাকৃতির প্রাণীকে হেঁটে যেতে দেখেছিলেন বলে দাবি করেন।
১৯২৫ সালে একজন গ্রিক ফটোগ্রাফার এবং রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির সদস্য না টম্বাজি দাবি করেন, তিনি হিমালয়ের ১৫ হাজার ফুট উঁচুতে একটি মানবসদৃশ প্রাণীকে দূর থেকে হেঁটে যেতে দেখেছেন। পরে তার পায়ের ছাপও দেখেন তারা। যদিও তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন না ওই প্রাণীটি ইয়েতি হতে পারে।
১৯৪৮ সালে পিটার বায়ার্ন নামে এক ব্যক্তি ভারতের উত্তর সিকিমে বিশালাকৃতির পায়ের ছাপ দেখতে পান বলে দাবি করেন। ১৯৫১ সালে এরিক শিপটন নামে এক ব্যক্তি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০ হাজার ফুট উপরে ইয়েতির পায়ের ছাপের ছবি তুলেন। পরে সেই ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হলে বিশ্বজুড়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু এ পায়ের ছাপগুলো কোন প্রাণীর সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
১৯৫৩ সালে স্যার এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার সময় বড়ো বড়ো অনেকগুলো পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে ইয়েতির সন্ধানে তিনি আবারো অনুসন্ধান চালান এবং একটি অজানা প্রাণীর লোম নিয়ে ফিরে আসেন। অনেক গবেষণার পর সম্প্রতি জানা গেছে, ওই লোম ছিলো হিমালয় অঞ্চলের প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক প্রজাতির অ্যান্টিলোপের গায়ের লোম।
১৯৫৪ সালে নেপালের একটি আশ্রম থেকে ইয়েতির মাথার চুল আবিষ্কার করার দাবি উঠেছিলো। পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি গবেষণা শেষে জানানো হয়, ওই চুল কোন প্রাণীর তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৬ সালে শোভোমির রাভিটজ নামে এক পোলিশ পর্যটকের বই থেকে জানা যায় ১৯৪০ সালে হিমালয়ে অভিযান চালানোর সময় তিনি ও তার সহযাত্রীরা দু'পেয়ে দুটি প্রাণীর দেখা পেয়েছিলেন।
বৃটিশ পর্বতারোহী ডন হোয়াল্যান্স ১৯৭০ সালে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে আরোহণ করার সময় প্রথম ইয়েতির ডাক শুনতে পান বলে জানা যায়। এক বিশাল দু’পেয়ে জন্তুকে রাতের বেলা ক্যাম্পের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে দেখেন তিনি। পরে জন্তুটির বড় বড় পায়ের ছাপও দেখেন তিনি। তার বর্ণনা অনুযায়ী, দু’পেয়ে জন্তুটি দেখতে ছিলো বনমানুষের মতো।
১৯৮৩ সালে ড্যানিয়েল সি টেইলর ও রবার্ট ফ্লেমিং জুনিয়র নামে দুই ব্যক্তি নেপালের বরুন উপত্যকায় ইয়েতি অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে তারাও বড় বড় পায়ের ছাপ দেখতে পেলেন। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলেন, দুই ধরনের ভাল্লুকের পায়ের ছাপ হতে পারে ওগুলো। ভাল্লুকের খুলির নমুনাও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলো। খুলি পরীক্ষা করে গবেষকরা নিশ্চিত হন, ওই খুলি এশিয়ার কালো ভাল্লুকেরই কোনো প্রজাতির।
ইয়েতির খোঁজে ২০০৭ সালে আমেরিকান টিভি উপস্থাপক জশুয়া গেটস তার দলবল নিয়ে নেপালে অভিযান চালিয়েছিলেন। বড় বড় কিছু কিছু পায়ের ছাপও খুঁজে পেলেন তারা। পায়ের ছাপগুলো লম্বায় ছিলো ১৩ ইঞ্চি আর পাশে ছিলো ৯ ইঞ্চিরও বেশি। ২০০৯ সালে গেটসের দল আবারও গেল হিমালয়ে। এবার ইয়েতির কিছু লোম পাওয়ার দাবি করলেন তারা। ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেলো লোমের ডিএনএ সিকোয়েন্স পরিচিত কোনো প্রাণীর মত নয়।
২০০৮ সালে উত্তর পূর্ব ভারতের একটি পাহাড় থেকে পাঠানো কিছু লোমের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় ওই লোমও প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতির অ্যান্টিলোপের গায়ের লোম।
দুই পায়ে হেটে বেড়ানো ভাল্লুকের মতো এই প্রাণীটি কি হতে পারে তা নিয়ে চালানো গবেষণায় বের হয়ে এসেছে দারুণ দারুণ সব তথ্য। এটি বানর জাতীয় বড় কোনো প্রাণী, ধূসর বা নীল ভাল্লুক কিংবা হিমালয়ের লাল ভাল্লুক বলেও দাবি করেছেন অনেকে। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান সাইকস ও তাঁর সহযোগীরা একটি গবেষণা চালান। নরওয়ে থেকে সংগৃহীত ৪০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার বছরের পুরোনো মেরুভাল্লুকের চোয়ালের হাড়ের সঙ্গে ‘ইয়েতির’ চোয়ালের হাড়ের জিনগত বৈশিষ্ট্যের শতভাগ মিল পেয়েছেন বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিলুপ্ত মেরুভালুক ও প্রায় সমজাতীয় বাদামি ভাল্লুকের সংকর প্রাণীটিই কালে কালে ইয়েতি নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
আপনাদের কি মনে হয় ইয়েতি কি শুধুই কল্পনাসৃষ্ট নাকি মানুষের চোখের আড়ালে হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে এখনো বড় বড় পায়ের ছাপ ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে রহস্যময় ইয়েতিরা ???
Post a Comment