'কুন ফায়া কুন' হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হিন্দু-মুসলিম সবার 'রহমতদার'


বিক্রম পাঠক: দিল্লিতে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। দুপুরের মধ্যে পরীক্ষা শেষ। আমার ট্রেন রাতে। তাই সারাদিন আর কোথায় ঘুরে বেড়ায়। এদিকে হোটেল ছেড়ে দিয়েছি সকালেই। পকেটে খুব বেশি টাকা নেই। কোথায় যাই কোথায় যাই- ভাবতে ভাবতে মাথায় এল একটা জায়গার কথা। ইমতিয়াজ আলির রকস্টার সিনেমাতে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া দেখেছি। রণবীর কাপুর বাড়ি থেকে পালিয়ে সেখানে গিয়েছিল। কেউ তাকে সেখানে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেনি। তাকে এমনই থাকতে দিয়েছিল। ব্যাস! আমিও হাজির হলাম। একটাবার দেখতে, কেমন এই জায়গা। অটোতে ২০ টাকা ভাড়া লাগলো ইন্ডিয়া গেটের সামনে থেকে। চলে গেলাম হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম প্রচুর মানুষ বসে আছে। আর বাইরে একজন কাওয়াল তাঁর চেনা গলায় গাইছেন "অ্যাই রহমতগার, তেরে দার পার আয়া হু" । সুরেলা কন্ঠ একেবারেই নয়। গাইতেও তার কষ্ট হচ্ছে। লোকটা বয়স্ক। আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম। সুফিয়ানার প্রতি যে অকৃত্রিম ভালবাসা আছে সেটাকেই সেদিন হাজির করলাম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া একটি অচেনা ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে সেদিন হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়াতে বসে সুফি গাইলো। কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করল না তার পরিচয়। বিকেলে আমাকে পুরি (ডালপুরি) আর ঘুগনি খেতে দেওয়া হল। এটাই নিজামুদ্দিনের লঙ্গর। যে লঙ্গরে কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় না তোমার জাতি কী?       
নিজামুদ্দিন আউলিয়াতে একটা সাধারণ সন্ধ্যা
হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া, যিনি মাহবুবে ইলাহি নামে সমধিক পরিচিত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে পরম শ্রদ্ধাস্পদ ও আদরণীয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় আটশ তিন বছর পরেও তাঁর আবেদন এতটুকু কমেনি, বরং দিনকে দিন আরও বেড়ে চলেছে। তাঁর মাজারে সমাগম ঘটে সকল পেশার মানুষের: শিল্পী, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ছাত্র, অভিনেতা, লেখক, দিনমজুর, আমলা, কে নেই তাদের মধ্যে! কেউ আসছেন যেয়ারতের (প্রার্থনা) উদ্দেশ্যে, কেউ বা মানত নিয়ে। মাহবুবে ইলাহি কেবল গরিব-দুখির আশ্রয়স্থল ছিলেন না, রাজা-বাদশারাও তাঁর পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজাধিরাজ, সুলতানদের সুলতান। দিল্লির সম্রাট এবং রাজপরিবার-পরিষদ তাঁর প্রতি কি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
হজরত নিজামুদ্দিনের সামনে বসে প্রার্থনা গাইছেন সম্রাট বাবর

হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর পর তার শবযাত্রায় স্বয়ং অংশ নিয়েছিলেন সদ্য দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক। হযরতের মাজার শরিফের উপর তিনি একটি গম্বুজ তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মাজার শরিফের সংস্কার কাজ করেন সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক। ফিরোজ গম্বুজের চারপাশে চারটি স্বর্ণের পাত্র স্থাপন করেন। সেগুলো আজও আছে। 
মোগল বাদশাহগণ মাহবুবে ইলাহির প্রতি গভীর ভক্তি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়ে মোগল বাদশা বাবর তাঁর দরগায় অর্ঘ্য নিবেদন করেন। জালালউদ্দিন আকবর একটি হত্যাপ্রচেষ্টা এড়ানোর পর এটিকে হযরতের আশীর্বাদ হিসেবে কবুল করেন, এবং তাঁর মা হামিদা বানু বেগমকে সাথে নিয়ে হযরতের দরগাহ যেয়ারত করেন। বাবরপুত্র হুমায়ুনের সমাধি হযরতের দরগাহর পাশেই। তাঁর সমাধি হিসেবে এই স্থানটি পছন্দ করা হয় হযরতের প্রতি হুমায়ুনের প্রথম বিবি হাজি বেগমের শ্রদ্ধা ও ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ। আর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যখন তাঁর পুত্র খুররম (উত্তরকালে শাহজাহান নামে খ্যাত) বিদ্রোহ করেন, তখন জাহাঙ্গীর হযরতের দোয়া কামনা করেছিলেন।
কেন মাহবুবে ইলাহি সম্রাট এবং সাধারণ মানুষ – সকলের কাছেই এত প্রিয়? এর একটাই উত্তর: সারাটা জীবন হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখেছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে দিয়েছেন আপন রহমতের ছায়া। এই দেশের বুকে হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাছে যখন হিন্দু-মুসলমান সবাই সমান, তখন কোন সরকার বা রাষ্ট্রশক্তি এর এই সংস্কৃতিকে নষ্ট করতে পারবে না।  

Blogger দ্বারা পরিচালিত.