বিরিয়ানির আসল নাম 'ওন সুরু', বিদেশ থেকে আসেনি, ছিল ভারতেই


Odd বাংলা ডেস্ক: বিরিয়ানি পছন্দ করেনা এমন মানুষ ক’জন আছে বলুন? কাচ্চি কিংবা তেহারীর নাম শুনেছেন অথচ জিভে জল চলে আসেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। এই চিত্র যে শুধু আমাদের দেশে তা কিন্তু নয়। গোটা ভারতবর্ষের প্রতিটি আনাচে কানাচে সেই চারশ বছর আগের মুঘল আমল থেকে আজ অবধি এতটুকুও কমেনি বিরিয়ানির আবেদন।

রাস্তার ধারে বড় তামার হাঁড়ি আর তার মুখে ময়দার প্রলেপ লাগানো দেখলেই লোভ সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। আর একবার সেই গন্ধটি গেলে তো কথাই নেই। হাজার ডায়েটিং, কোলেস্টেরল, ফ্যাটি লিভার সব গোল্লায় গিয়ে মাথায় শুধু উঁকি মারে বিরিয়ানি। না না করেও ঠিক চলে যায় সেই গন্ধ ওঠা রেস্তোরাঁয়। সাদা ধবধবে প্লেটে লম্বা লম্বা হলুদ-সাদা চাল, নরম তুলতুলে আলু আর মাখোমাখো মাংসের জন্য  অপেক্ষা। ঠিক এভাবেই বিরিয়ানির জাদুতে মজে আট থেকে আশি।

কিন্তু কোথা থেকে এলো এমন মন ভালো করে দেয়া খাবারটি? এছাড়া বিরিয়ানির নাম তো অন্য কিছুও হতে পারত? এগুলো তো জানার আগ্রহ থাকতেই পারে।

বিরিয়ানিপ্রেমীর সংখ্যাটা একবারে কম নয়। কিন্তু আদতে এ দেশের খাবারই নয় এই বিরিয়ানি। পারস্য থেকে আমদানি হয়েছিল জিভে জল আনা লোভনীয় এ খাবারটি। পার্সিয়ান শব্দ ‘বিরিয়ান’ কথার অর্থ হলো ‘রান্নার আগে ভাজা চাল’। সেখান থেকেই বিরিয়ানি কথাটির জন্ম। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিং অঞ্চলে যে “বিরন করা” শব্দটি ব্যবহৃত হয় সেটা এই ফারসি শব্দেরই পরিবর্তিতরূপ।

অনেকে বলেন, তৈমুর লঙ্গের হাত ধরে ১৩৯৮ সালে ভারতে এসেছিল বিরিয়ানি। মাটির পাত্রে চাল, মশলা আর মাংস মিশিয়ে একসঙ্গে রান্না করা হত। তখন প্রধানত সৈন্যদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত বিরিয়ানি।

আবার প্রচলিত আছে, লঙ্গের বহু আগে ২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরবের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বিরিয়ানি আসে ভারতে। তামিল সাহিত্যে ‘ওন সরু’ নামে এক ধরনের খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাত, ঘি, হলুদ, ধনে, মরিচ, তেজপাতা, মাংস দিয়ে তৈরি হত এই খাবার। যার সঙ্গে আধুনিক বিরিয়ানির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।

তবে বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা পায় মুঘল সম্রাটদের আমলে। মুমতাজ মহলের রোজকার খাদ্য তালিকায় বিরিয়ানির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিরিয়ানি খেতে খুবই ভালবাসতেন শাহজাহানের এই সুন্দরী বেগম। কথিত, একবার নাকি মুঘল সেনা ছাউনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেখানেই বিরিয়ানি রান্না হতে দেখেন তিনি।

রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সৈন্যদের ‘ব্যালান্স ডায়েট’ দেয়ার জন্য ভাত ও মাংস মাখানো এই খাবার দেয়া হয়। নতুন এই খাবারটি চেখে দেখে মুখে স্বাদ পেয়ে গিয়েছিলেন মুমতাজ। সেই সূত্রপাত।

শুধু মুঘল রাজপরিবারই নয়, লক্ষ্ণৌ-এর নিজাম প্যালাসেও বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা ছিল মারাত্মক। নিজাম পরিবার থেকেই রকমারি বিরিয়ানির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে যত বাহারি রকমেরই হোক না কেন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় ‘দম পুখত’ বিরিয়ানি।

প্রধানত মশলার ভেদাভেদের উপরই নির্ভর করে বিরিয়ানির স্বাদ। মশলা পরিবর্তন করেই তৈরি করা যায় হরেক রকমের বিরিয়ানি। এদের নামও আলাদা। উত্তর ভারতে আগে লম্বা দানার ব্রাউন রাইস ব্যবহার করা হত বিরিয়ানির প্রধান উপাদান হিসাবে। এখন অবশ্য বেশির ভাগ জায়গাতেই বাসমতি চাল ব্যবহার করা হয়। আবার স্থানীয় বিভিন্ন ধরনের চাল দিয়ে তৈরি হয় বিরিয়ানি। যেমন, জিরা সাম্বা, কাইমা, জিরাকাশালা, কালা ভাত ব্যবহার করা হয়।

ভারতবর্ষের গত ৪০০ বছরের ইতিহাসে বিরিয়ানি এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে একে শুধু একটি খাবারের নাম বললে ভুল হবে। আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-পার্বণে এবং অনেক জাতীয় অর্জন ও শঙ্কটের নীরব সাক্ষী এক প্লেট বিরিয়নি। তাই নিছক পেট ভরানো কিংবা মুখোরোচকতার সীমা পেরিয়ে বিরিয়ানি যেন মিশে গেছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের সাথে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.