দিল্লির ছবি আজ মনে করিয়ে দিল কলকাতার দাঙ্গার কথা


Odd বাংলা ডেস্ক: ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ, লাহোর প্রস্তাবে জিন্না বললো, "ভারতবর্ষের সমস্যা সম্প্রদায়গত নয়, বরং জাতিগত। এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দুরা, ইসলাম ও হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না। ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতিসত্ত্বা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ, অন্যজনের শত্রু। মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়। মুসলমান একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের আছে। তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে।" (ভিপি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃষ্ঠা-৮২)
ঠিক এর ১০ দিন পর, ১৯৪০ সালের ৬ এপ্রিল, গান্ধী, মুসলিম লীগের দাবিকে সমর্থন করে হরিজন পত্রিকায় লিখলো, "দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো মুসলমানদেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। বর্তমানে আমরা একটা যৌথ পরিবারের মতোই বসবাস করছি। তাই এর কোনো এক শরিক ভিন্ন হতে চাইতেই পারে।"
মূলত এই দুটি ঘটনাতে ১৯৪০ সালেই ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছিলো; ১৯৪৭ সালে তা শুধু বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র।
মুসলমানরা যাতে পাকিস্তানের দাবীকে ভুলে না যায়, সেজন্যই হয়তো ১৯৪২ সালের ১৮ এপ্রিল, গান্ধী, হরিজন পত্রিকায় আবার লিখলো, "যদি ভারতের বেশির ভাগ মুসলমান এই মত পোষণ করে যে, মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি, যাদের সঙ্গে হিন্দু ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মিল নেই, তবে পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যে সেই চিন্তা ভাবনা থেকে তাদের বিরত করতে পারে এবং সেই ভিত্তিতে তারা যদি বেশির ভাগ চায়, তবে অবশ্যই দেশভাগ করতে হবে। তবে ইচ্ছা করলে হিন্দুরা তার বিরোধিতা করতে পারে।"
জিন্না দেখলো, তার দাবীর তেমন কোনো বিরোধিতা হিন্দুদের মধ্যে নেই, বরং হিন্দুদের প্রধান নেতা গান্ধীর, তার দাবীর ব্যাপারে যথেষ্ট অনুমোদনও রয়েছে।


সেদিন এভাবেই কলকাতার রাস্তায় পড়েছিল শয়ে শয়ে মৃতদেহ

এরপর ১৯৪৪ সালে জিন্নার সাথে গান্ধীর বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। গান্ধী, জিন্নাহকে বলে, "আমি আপনার বা ইসলামের শত্রু নই। আমি আপনাদের দীন সেবক মাত্র। আমাকে দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না।" গান্ধীর এই অসহায় আত্মসমর্পনে উৎফুল্ল জিন্না পাকিস্তান আদায়ের প্ল্যান তৈরি করে ফেলে। কারণ, জিন্না বুঝেছিলো, শুধু মুখে বলে কিছু আদায় হবে না, এর জন্য এ্যাকশনে যেতে হবে। তাই ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই বোম্বেতে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের জাতীয় সভায়, ১৬ আগস্টকে জিন্না, "ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে" বা "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস" হিসেবে ঘোষণা করে। এই সভায় জিন্না বলে, "পাকিস্তান বাদ দিয়ে অন্য কিছুর সাথেই মুসলমান জাতি কোনো প্রকার আপোষ করবে না। এখন সময় হয়েছে, সেই দাবী আদায়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার। আমরা আজ একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সব সময়ই আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই দাবী জানিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ সময় এসেছে সেই নিয়মতান্ত্রিক পথকে বিদায় জানাবার।...আজ আমাদের কাছে একটি পিস্তল আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে সমর্থ।" ( পীরজাদা, ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-৫৬০)
শুরু হলো প্রস্তুতি:
১৯৪৬ সালে সমগ্র বাংলায় মুসলমান ছিলো ৫৫%, হিন্দু ৪৫%। তাই খুব সহজে কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে বাংলার ক্ষমতা দখল করে মুসলিম লীগ। সোহরাওয়ার্দী বা সুরাবর্দী হয় মুসলিম সরকারের মূখ্যমন্ত্রী; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ছিলো তার হাতে। জিন্নার ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় এই জল্লাদ। ২৮ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট, সময় খুব কম। তাই খুব দ্রুত পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে সে। ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট, স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে সুরাবর্দী লিখে, "হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় ছাড়া অন্য কোনো প্রিয় কাজ নেই।"
এই দিনই খাজা নাজিমুদ্দিন, যে পরে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়, সে মুসলিম ইনস্টিউটে, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের এক সমাবেশে বলে, "মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে, এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে। কারণ, এই রমজান মাসেই তো জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ।"
এর সাথে কলকাতার মুসলমান মেয়র, ওসমান খান, উর্দুতে একটি প্রচার পত্র বিলি করে। যাতে লিখা ছিলো, "আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও, ওহে কাফের, তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়।" এই লিফলেটে ছিলো তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবি। এছাড়াও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে, হিন্দুদের কিভাবে ধ্বংস করা যাবে, সেই রকম ২৩ টি নির্দেশনা সংক্রান্ত একটি লিফলেট বিলি করা হয়। নির্দেশনাগুলো এরকম :
১. ভারতের সকল মুসলমান পাকিস্তানের দাবীতে প্রাণ দেবে।
২. পাকিস্তান জয়ের পর সারা ভারত জয় করতে হবে।
৩. ভারতের সব মানুষকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে।
৪. সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকেই বৃটিশ-আমেরিকার পৃথিবী শোষণের সাথে হাত মেলাতে হবে।
৫. একজন মুসলমানকে ৫ জন হিন্দুর অধিকার পেতে হবে, অর্থাৎ একজন মুসলমান সমান ৫ জন হিন্দু।
৬. যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত স্থাপিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত নিম্নলিখিত কাজগুলি করে যেতে হবে:
ক) হিন্দুদের যত কারখানা ও দোকান আছে, তা ধ্বংস করতে হবে এবং লুঠ করতে হবে এবং লুঠের মাল মুসলিম লীগ অফিসে জমা দিতে হবে।
খ) মুসলিম লীগের সব সদস্যকে অস্ত্র বহন করতে হবে।
গ) সকল জাতীয়বাদী মুসলমান, যারা লীগের সাথে যুক্ত হবে না (অর্থাৎ কংগ্রেসী), তাদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করতে হবে।
ঘ) হিন্দুদেরকে ক্রমাগত খুন করে যেতে হবে এবং তাদের সংখ্যা কমাতে হবে।
ঙ) সমস্ত মন্দির ধ্বংস করতে হবে।
চ) কংগ্রেস নেতাদেরকে প্রতিমাসে ১ জন করে খুন করতে হবে।
ছ) কংগ্রেসের অফিসগুলি মুসলমানদের দিয়ে ধ্বংস করাতে হবে।
জ) করাচী, বোম্বাই, কলিকাতা, মাদ্রাজ, গোয়া বিশাখাপত্তনম ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অচল করে দিতে হবে।
ঝ) কোনো মুসলমানকেই হিন্দুদের অধীনে সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, সরকারী, বেসরকারী কোথাও কাজ করতে দেওয়া হবে না।
ঞ) মুসলমানদেরকে সমস্ত ভারত ও কংগ্রেসকে অন্তর্ঘাত করে যেতে হবে, মুসলমানদের দ্বারা শেষ ভারত আক্রমন পর্যন্ত।
ট) এসব ব্যাপারে অর্থ দেবে মুসলিম লীগ।
ঠ) সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোম্বাই, দিল্লী, কলিকাতা, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, লাহোর, এবং করাচির মুসলমানদের হাতে ভাগ করে দেওয়া হবে।
ড) মুসলিম লীগের সব সদস্য অস্ত্র ব্যবহার করবে, এমনকি দরকার হলে পকেটে রাখার মতো ছোড়া ব্যবহার করবে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত হিন্দুদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
ঢ) সমস্ত বাহন হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
ণ) সমস্ত হিন্দু নারী ও মেয়েদেরকে ধর্ষণ করবে, লুঠ করবে, ইসলামে ধর্মান্তরিত করবে ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ সাল থেকে।
ত) হিন্দু সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে হবে।
থ) লীগের সমস্ত সদস্যরা হিন্দুদের প্রতি সব সময় নিষ্ঠুর ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে সামাজিক অর্থনৈতিক সব ব্যাপারে পরিত্যাগ করবে।
এসবের পাশাপাশি নোয়াখালি, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, নদীয়া, ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় মুসলিম লীগের আহ্বানে অনুষ্ঠিত জনসভায় আকার ইঙ্গিতে মুসলমানদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, দেশে মুসলিম লীগের সরকার আছে, সুতরাং পাকিস্তান আদায়ের জন্য ১৬ আগস্ট থেকে অগ্নি সংযোগ, লুঠ, নারী অপহরণ, ধর্ষণ, খুন এসবের জন্য কারো কোনো প্রকার শাস্তি হবে না।
এসব প্রচারের সাথে সাথে বাইরে থেকে প্রচুর সংখ্যক মুসলমানকে কলকাতায় এনে বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে রাখা হয়।
এছাড়াও এ্যাকশন শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই চোখে পড়ছিলো যেসব খণ্ডিত দৃশ্য :
বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, কলাবাগান বস্তি, ক্যানাল ওয়েস্ট রোড, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, এন্টালি প্রভৃতি এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরেই মুসলমানরা বিভিন্নরকম অস্ত্রশস্ত্রে ধার দিচ্ছিলো।
বেলগাছিয়া, বি.টি রোডে - লাঠি, ছোরা ও তরোয়াল ভর্তি লরি দেখা গিয়েছিলো।
মানিকতলায় ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে অস্ত্র ভর্তি ঠেলাগাড়ি দেখা গিয়েছিলো।
এবং মুসলমানদের দোকানগুলোতে পাকিস্তান লিখে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
এ্যাকশনে ট্রাক / লরির ব্যবহার :
কলকাতার মেয়র ওসমান খান, কর্পোরেশনের সব লরি মুসলিম লীগের নেতাদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলো, যাতে করে মুসলমানরা সে সব লরি ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো লুঠপাট করতে পারে আর হিন্দুদেরকে মারার জন্য অস্ত্র শস্ত্র বহন করে বিভিন্ন এলাকার মুসলমানদের হাতে তা পৌঁছে দিতে পারে। আর এই লরিগুলো যাতে ঠিক মতো চলতে পারে, সেজন্য সুরাবর্দীর সরকার, সেই সময় পেট্রোলের যথেষ্ট অনটন থাকা সত্ত্বেও, ঢালাও ভাবে, লুঠপাট ও হিন্দু হত্যার কাজে নিয়োজিত লরিগুলোর জন্য পেট্রোলের কূপন ইস্যু করেছিলো। এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসারত ইস্পাহানি মির্জাপুর চা কোম্পানির মালিক ইস্পাহানি ছিলো সেই সময় সুরাবর্দী সরকারের চাউল সরবরাহকারী। ইস্পাহানি নিজের সব লরি মুসলিম লীগের লোকজনদেরকে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর সময় ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলো। এসব লরিতে মুসলিম লীগের পতাকা টানিয়ে তা সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো। আর এসব লরি, যাদের পেট্রোলের কূপন ছিলো না, তারা জোর করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল আদায় করেছিলো।

১৮ দিন ধরে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, ১৫ আগস্ট ১৯৪৬ তারিখে, মুসলিম লীগ ১৬ আগস্টে বাংলা বন্ধের ডাক দেয়, আর কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ দিন ঘোষণা করে সরকারী ছুটির। উদ্দেশ্য, যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করতে পারে ও তাদের ধন-সম্পত্তি লুঠ করতে পারে। এ্যাকশনে অংশগ্রহনে ইচ্ছুক মুসলমানদেরকে, কলকাতা শহরকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে, একেক এলাকার দায়িত্ব, একেক এলাকার মুসলমানদেরকে দেওয়া হয়। যেমন- বেলগাছিয়ার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে পুরো বেলগাছিয়া এলাকাকে বিধ্বস্ত করার। রাজাবাজার এলাকার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে মানিকতলা থেকে শিয়ালদহ এবং বৌ বাজার ও কলেজস্ট্রিট এলাকা। কলাবাগান বস্তির মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট হয় হ্যারিসন রোড, বড়বাজার, ঠনঠনিয়া, মার্কাস স্কয়ার, ফলপট্টি অঞ্চল। কলুটোলা, জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদ, টেরিটি বাজার, ফিয়ার্স লেন এলাকার মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়- লালবাজার থেকে চিৎপুর এবং ক্যানিং ও এজরা স্ট্রিট অঞ্চল। এছাড়াও ধর্মতলা, তালতলা, ওয়েলেসলি, পার্কসার্কাস, বেলেঘাটা, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজের মুসলমানদের উপর ভার পড়ে স্ব স্ব এলাকার হিন্দুদেরকে হত্যা করার ও তাদের ধনসম্পত্তি লুঠপাট করার।
এছাড়াও এই হিন্দু হত্যার প্রত্যক্ষ পরিচালক জনৈক রহমান আলী ১৫ আগস্ট রাতেই তার লোক জন নিয়ে কোলকাতায় এসে পড়ে এবং মুসলমান গুণ্ডাদেরকে খিদিরপুর, কলুটোলা, রাজা বাজার, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, তালতলার বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে। রহমান আলী সবাইকে বলে দিয়েছিলো, লুঠের মালের ভাগ কাউকে দিতে হবে না। আর খুন-ধর্ষণ-অপহরণে পুলিশ কোনো নাক গলাবে না, সরকার থেকে এসব দেখবে।
ভেতরে ভেতরে এসব প্রিপ্যারেশন নেওয়া হলো আর মুখে বলা হলো, ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা এখানে সেখানে মিছিল মিটিং করে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠন করবে, এককথায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হবে শান্তিপূর্ণ!
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট, বাংলা জুড়ে হরতালের / বন্ধের ডাক দেয় এবং সূরাবর্দীর সরকার দেয় সরকারী ছুটির ঘোষণা । মুসলিম লীগের এই যৌথ কর্মসূচীতে কংগ্রেস কিছুটা হৈচৈ করে বটে; কিন্তু আইনসভার চার দেয়ালের মাঝেই তা আটকে থাকে, এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এটাকে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই কংগ্রেস করে নি। একমাত্র ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভা জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচী চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কংগ্রেসের মতো ব্যাপক জনসমর্থন না থাকায় লোকজনের মাঝে তা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, শান্তিপূর্ণ ভাবে পালন করা হবে, জিন্না ও মুসলিম লীগের এই মিথ্যা আশ্বাসে ভুলে গান্ধী চুপ করে থাকে। আর নেহেরু বললো, যারা বন্ধ সমর্থন করে না, তারা যেন প্রতিদিনের মতোই হাট, বাজার, অফিস করে।
মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত স্ট্যান্ড নেয় কমিউনিস্ট পার্টি। ১৩ আগস্ট, ১৯৪৬ এ পার্টির নেতা জ্যোতিবসু এক প্রচার বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, "মূলত আমাদের পার্টির চেষ্টা হবে মুসলিম লীগের ডাকা বাংলা বন্ধের দিন রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাই যেখানে প্রয়োজন আমরা বন্ধ সমর্থন করবো, আর যেখানে প্রয়োজন নয়, সেখানে বন্ধের বিরোধিতা করবো।" কমিউনিস্টদের চরিত্র আসলে মেয়ের, না পুরুষের, না অন্য কোনো কিছুর ? জ্যোতিবসুর এই মন্তব্য থেকে সেটা আপনারাই বিচার করে নিন। কেননা, কমিউনিস্টদের সিদ্ধান্ত ছিলো, যেখানে বন্ধের প্রয়োজন, অর্থাৎ মুসলিম এলাকায় ওরা বন্ধ সমর্থন করবে; আর যেখানে বন্ধের প্রয়োজন নেই, অর্থাৎ হিন্দু এলাকায় বন্ধ সমর্থন করবে না, বন্ধের প্রতিবাদ করবে। ১৪.৮.১৯৪৬ তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছিলো কমিউনিস্ট পার্টির এই বেশ্যানীতির খবরটি।
কোলকাতার মেয়র ওসমান খান এবং তার সহযোগী সেরিফ খান, সক্রিয়ভাবে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর এই হিন্দু হত্যাকে পরিচালনা করে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ছিলো মূখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর হাতে। এই এ্যাকশনে পুলিশ-প্রশাসনের কোনো সাহায্য যাতে হিন্দুরা না পায়, সেজন্য রাজ্যের ২৪টি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের সব কয়টি থেকে হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে ২২টিতে মুসলিম পুলিশ অফিসার এবং ২টিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসার নিয়োগ করে সুরাবর্দী। শুধু তাই নয়, ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই সুরাবর্দী এবং মেয়র ওসমান খান বসেছিলো লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে এবং সেখান থেকেই তারা নজর রাখছিলো মুসলমানরা কোন এলাকায় কত হিন্দু মারতে পারলো। এমনকি একটি থানা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ থানায় লালবাজার থেকে কোনো পুলিশ ফোর্স পাঠায় নি।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.