ট্রানসেলভেনিয়ার এবিজাবেথ বাথোরি, যে রানি সত্যিই প্রজাদের রক্ত পান করত


Odd বাংলা ডেস্ক: কে না চায় রূপ সৌন্দর্যে চির যৌবনা হয়ে থাকতে? পৃথিবীতে হয়তো এমন নারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল যিনি চান না নিজেকে সুন্দর রাখতে, অন্যের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখাতে। তাই তো নিজের সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে প্রসাধন, রুপচর্চা সহ আরও কত প্রচেষ্টা। এবং এই বিষয় গুলো খুবই স্বাভাবিকও। কিন্তু কেউ যদি নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য শত শত কুমারী মেয়ের রক্ত পান করে কিংবা তাদের রক্তে স্নান করে তবে সেটা মোটেও স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি বাস্তবেই ঘটেছে এবং সেটা আমাদের এই পৃথিবীতেই। যার নাম এই ঘটনার সাথে জড়িত সে হল বিশ্বের প্রথম নারী সিরিয়াল কিলার “এলিজাবেথ বাথোরি”। 

 ১৫৬০ সালের ৭ই আগস্ট হাঙ্গেরির নাইরবাটর এ জন্মগ্রহন করে এলিজাবেথ বাথোরি যার অপর নাম “ব্লাড কাউন্টেস” বা “কাউন্টেস ড্রাকুলা”। কারণ প্রচলিত তথ্য মতে সে কুমারী মেয়েদের হত্যা করে ভ্যাম্পায়ারদের মত তাদের রক্ত পান করত। অভিজাত পরিবারের মেয়ে হওয়ার ফলস্বরুপ তার বিয়েও হয়েছিল অভিজাত পরিবারেই। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী যুদ্ধে চলে গেলে, পরিবার পরিচালনার সম্পুর্ন ক্ষমতা চলে আসে তার হাতে। ধারনা করা হয়, ঐ সময়েই সে তার বিকৃত চিন্তাধারার বাস্তব রূপ দিতে থাকে তার কিছু কাজের লোক ও দাসের সাহায্য নিয়ে। যখন তার বিচার করা হয় তখন প্রধান দুই সহযোগীর ভাষ্যমতে সে ৫০ জন মেয়েকে হত্যা করেছিল, এবং তৃতীয় জনের মতে ৮০ জন। এই ৮০ জন মেয়ের হত্যার দায়ে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আসলে তার হত্যা করা নারীর সংখ্যা ছিল ৬৫০ এরও অধিক যা জানা যায় নিজের হাতে লেখা ডায়েরি থেকেই। 

তার সকল অপকর্মের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সেই ডায়েরিটি আদালতের সামনে উপস্থাপন করেছিল। এলিজাবেথের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক খুনি হয়ে গড়ে উঠার পিছনে অনেক রকম মতবাদ অবশ্য প্রচলিত। শিশু বয়সেই এলিজাবেথ ভয়ানক অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিল। একদম ছোটকাল থেকেই খিটখিটে, বদমেজাজি আর বিগড়ে যাওয়া এলিজাবেথ কে কখনও কোন অত্যাচারের শিকার হতে হয় নি কিন্তু তারপরও তার ভিতরে ক্রোধ আর হিংসা ছিল অনেক বেশি। খুব অল্প বয়স থেকেই তার দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন, হঠাৎ কাঁপুনি এবং মাইগ্রেনের মত রোগ ছিল তার। ছোটবেলা থেকেই সে ভয়ানক সব অত্যাচারের দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত ছিল। সেইসব ভয়ানক ঘটনার একটি ঘটনা এমন ছিল যেখানে এলিজাবেথ দেখে একটি জীবন্ত ঘোড়ার পেট কেটে তাতে একজন অপরাধীকে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর আবার পেটটা সেলাই করে দেওয়া হয়। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘোড়া আর অপরাধী দুইজনই মারা যায় ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। এইরকম ভয়ানক দৃশ্য তার ভিতরের হিংসাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে একটি জারজ সন্তানের জন্ম দেয় এলিজাবেথ। কিন্তু ১৫ বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয় ফেরেন্স নাডাসডি নামে এক উচ্চবংশীয় লোকের সাথে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে ফেরেন্সও তার স্ত্রীর মতই অত্যাচারী ছিলেন। অটোম্যান বন্দিদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাতেন, নিজের দাসদের দুই পায়ের গোড়ালির মাঝে কাগজ রেখে আগুন ধরিয়ে দিতেন বলে জানা যায়। 

এ ছাড়াও অটোম্যানের যুদ্ধে তার নৃশংসতার জন্য তার নাম দেয়া হয় “ ব্ল্যাক হিরো অফ হাঙ্গেরি”। তবে বাথোরি পরিবারে এলিজাবেথই একমাত্র খুনি না হয়তো। গুজব রয়েছে যে এলিজাবেথের পিসিও একজন খুনি, উভকামী ছিলেন। এলিজাবেথের পরিবার ট্রান্সিল্ভেনিয়ার অন্যতম অভিজাত বংশের একটি। তার কাকা স্টিফেন বাথোরি পোল্যান্ডের শাসনকারী রানী কে বিয়ে করেন এবং তিনি নিজে একজন দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু এলিজাবেথের পিসি ক্লারা বাথোরি ছিলেন তার মতই বিকারগ্রস্থ। সমসাময়িক তথ্য মতে ক্লারার একজন প্রেমিক ছিল যে তার স্বামীকে হত্যা করেছিল, কিন্তু গুজব আছে যে ক্লারা নিজেই তার স্বামীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল। আবার অনেকের মতে সে একজন উভকামী ছিল আর সে তার অবসর সময়ে কালো জাদু চর্চা করতো এবং সে এলিজাবেথ কেও উৎসাহিত করতো এইসব কাজকর্ম করার জন্য। 

অবশেষে ক্লারা কে জেলে পাঠানো হয়, কিন্তু সেখানে গিয়েও সে তার শৃগালের ন্যায় ধূর্ততা দিয়ে জেল রক্ষীদের তার ফাঁদে ফেলেছিল বলে জানা যায়। অবশ্য অনেকের দাবি ক্লারা ও তার এক প্রেমিক নাকি কোন এক অটোম্যান পাশার কাছে বন্দি হয়েছিল। এলিজাবেথের নৃশংসতার কথা বলে শেষ করা যাবেনা। শুধু কুমারী মেয়েদের হত্যা করে তাদের রক্ত পান করা বা তাদের রক্তে গোসল করা পর্যন্তই থেমে থাকেনি সে। তার কাছে বন্দি কুমারী মেয়েদের কে মারার জন্য সে এমন এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতো যা হয়তো আমরা কল্পনাতেও ভাবতে চাই না এবং তার অত্যাচারের ধরনে আরও বিচিত্রতা এসেছিল ফেরেন্সের সাথে তার বিয়ের পর। স্বামীর কাছ থেকে নতুন নতুন অত্যাচারের পদ্ধতি শিখেছিল এলিজাবেথ। সে মেয়েদের কে কন্টক যুক্ত খাঁচায় বন্দি করে রাখতো, সিলিং থেকে ঝুলিয়ে রাখতো, তাদের দিকে বরফ বা অত্যন্ত ঠান্ডা জল ছুড়ে দিত যেন তাঁরা ঠাণ্ডায় জমে মারা যায়। সে তার দাস দাসিদের হাতের তালুতে উত্তপ্ত লাল লোহা চেপে ধরে রাখাটা খুব উপভোগ করত। উপরন্তু সে সাঁড়াশি দিয়ে তাদের আঙ্গুল টেনে ছিঁড়ত। 

বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই ফেরেন্স যুদ্ধে চলে যান।কিন্তু সেখান থেকে সে তার স্ত্রীকে অত্যাচারের নতুন নতুন পন্থা লিখে পাঠাতো প্রেম পত্রের আড়ালে। স্বামীর পরামর্শ অনুযায়ী এলিজাবেথ তার কাজের মেয়েদের মধুতে লেপে সারাদিনের জন্য বাইরে রেখে আসতো যেন পোকামাকড় আর মৌমাছির কামড়ে মেয়ে গুলো মারা যায়। 

এলিজাবেথ কে স্বজাতিভক্ষকও বলে থাকেন অনেকে। কেননা কিছু কিছু তথ্য মতে জানা যায়, সে এক মেয়ের শরীর থেকে মাংস কেটে তাকে দিয়েই রান্না করিয়েছিল এবং তাকে নিজের মাংস খেতে বাধ্য করেছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর এলিজাবেথ আরও বেশি ভয়ানক আর নৃশংস হয়ে উঠে যা জানা যায় তার পরবর্তী বিচারকালীন ইতিহাস থেকে। সে মেয়েদের নখের নিচে, মুখের চামড়ার নিচে সুঁচ ফুটিয়ে রাখতো, মেয়েদের কে ক্ষত বিক্ষত করে আঘাত প্রাপ্ত স্থান থেকে মাংস কামড়ে নিতো কিংবা সাঁড়াশি দিয়ে তুলে নিতো মাংসপিণ্ড। 

এই ব্লাড কাউন্টেস বেশ বিশৃঙ্খল আর এলোমেলো জীবনযাপনের জন্যও পরিচিত। বিয়ের আগে তো তার প্রেমিক পুরুষ ছিলই, কিন্তু স্বামী থাকা অবস্থায় ও স্বামী মারা যাওয়ার পরও অনেক পুরুষের আগমন ঘটে তার জীবনে বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর শতাব্দী পরে অবশ্য তার উভকামী হওয়ার ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল অনেকে। কেন এলিজাবেথ এতো বেশি ভয়ানক আর নিষ্ঠুর তা বুঝার জন্য পণ্ডিতগণ তার জীবনের সকল দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন। কারও কারও মতে জন্মগত ত্রুটির কারণে এলিজাবেথ এত খুনে স্বভাবের ছিল। তাদের ধারনা যেহেতু তার মা বাবা দূর সম্পর্কের ভাই বোন ছিল তাই হয়তো কোন জীনগত সমস্যার স্বীকার সে। কিন্তু ঐ সময়ে ইউরোপিয়ান রেনেসাঁর যুগে দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের মাঝখানে বিয়ে খুব প্রচলিত বিষয় ছিল কিন্তু তার ফলে তো পুরো ইউরোপ এলিজাবেথের মত সিরিয়াল কিলার দিয়ে ভরে যায়নি। 

তাই জন্মগত কোন ত্রুটি এলিজাবেথের ছিল এই মতবাদ টা তেমন গ্রহণযোগ্য না অনেকের কাছে। অবশ্য এমন ও হতে পারে যে এলিজাবেথের কর্মকান্ড গুলোকে অতিরঞ্জিত করে বলা হয়েছে তার অতিরিক্ত বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কের কারণে। কারণ একজন মেয়ে হয়েও সে যেমন বেপরোয়া জীবন যাপন করছিল তা তখনকার পিতৃতান্ত্রিক সমাজের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই হয়তো এলিজাবেথের ঘটনা গুলো বেশ বাড়িয়ে বলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছিল যেন অন্য মেয়েরা তাকে দেখে উৎসাহিত না হয় বলেও মনে করেন অনেকে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে যে “ পাপ বাপকে ছাড়েনা”। এই প্রবাদ টি সত্যি হয়েছিল এলিজাবেথের জীবনেও। 

বছরের পর বছর রাজ্যের কুমারী মেয়েদের ধরে এনে হত্যা করে রক্ত পান আর রক্তে গোসল করতো সে। শুরুর দিকে গ্রামের গরিব লোকদের মেয়েদের কাজ দেয়ার কথা বলে এনে হত্যা করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন মেয়েরা নিখোঁজ হতে লাগলো তখন আর কোন বাবা মা তাদের মেয়েদের প্রাসাদে পাঠাতো না। পরবর্তিতে সে আরও বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠলো, তখন সে ট্রান্সিল্ভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যবিত্ত অভিজাত পরিবারের মেয়েদের কে ভালভাবে লালন পালন করার কথা বলে প্রাসাদে আনতে শুরু করলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা নিখোঁজ হতে শুরু করলে তাদের পরিবার গরিব কৃষকদের মত চুপ করে বসে না থেকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিষয় তা জানায়। এবং সর্বশেষ যে হত্যা টি এলিজাবেথের কাল হয়ে দাড়ায় সেটি হল একটি গানের দলের প্রধান মেয়ে কে যখন সে হত্যা করে। 



সাধারন ঘরের মেয়েদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সবার চোখে না পড়লেও, একজন বিখ্যাত শিল্পীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তা চোখে পড়ে সবার। তখন হাঙ্গেরির ক্যাথোলিক রাজা ম্যাঠিয়াস ২ যে আগে থেকেই বাথোরি-নাডাসডি পরিবারের সম্পদের বিরোধি ছিলেন, তিনি এলিজাবেথের বিরদ্ধে আনা সকল অভিযোগ খুতিয়ে দেখা শুরু করেন। তখন তিনি আর তার আইনসভা মিলে হাঙ্গেরির রাজ প্রতনিধি কাউন্ট জর্জ থার্জো কে বলেন সব খুঁটিয়ে দেখতে। এলিজাবেথের কেইসে ম্যাঠিয়াসের এতো বেশি আগ্রহের কারণ ছিল হয়তো সে তখন কালো জাদু তে বিশ্বাস করতো, আর তাছাড়া বিচারে বিধবা এলিজাবেথের শাস্তি হলে তার সকল সম্পত্তি রাজার হয়ে যেতো আর তার কাছে রাজার যে ঋণ ছিল তাও মওকুফ হয়ে যেতো। কিন্তু থার্জো ছিলেন বাথোরি পরিবারের বন্ধু। তিনি এলিজাবেথ কে বিচারকাজ থেকে পালাতে সহায়তা করেন যার ফলে এলিজাবেথের বদলে শাস্তি হয় তার সহযোগীদের। যেহেতু এলিজাবেথ বিচারে উপস্থিত ছিলনা তাই তার সহযোগীদের কে রিমান্ডে নেওয়া হয় তার সব অপরাধের কথা বলানোর জন্য। তবে বিচারে অনুপস্থিত থেকেও যে শেষ রক্ষা হবেনা সেটা এলিজাবেথ নিজেও বুঝে গিয়েছিল। 

১৬১০ সালে থার্জো এলিজাবেথের বিরুদ্ধে সাক্ষী আর প্রমাণ একত্র করতে শুরু করেন। তখন এলিজাবেথ কে নিজের পক্ষে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হইনি যার ফলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য আর প্রমাণেই বিচার হয় তার। শাস্তিস্বরুপ তাকে স্লোভাকিয়ায় তার পৈতৃক বাসভবনে তার কক্ষে প্রাচীর তুলে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দি অবস্থায় ৩ বছর থাকার পর ১৬১৪ সালে তার মৃত্যু হয় মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। এতো গুলো শিশু, কিশোরী, তরুণী আর যুবতী কে হত্যা করেও অমর হতে পারেনি ইতিহাসের ভয়ংকরতম সিরিয়াল কিলার এই নারী।

মডেল: টুইঙ্কাল ও রাজেশ 
মেক আপ: সন্দীপ ও শান্তি 
ফটোগ্রাফ: পাপাই 
পোশাক সৌজন্যে: চন্দ্রানী ধামালি

Blogger দ্বারা পরিচালিত.