কিছু শব্দ শুধু মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ, ভাষায় পুরুষের অবিচার


Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ্বের অনেক সাহিত্যে নারীর অবস্থানকে খাটো করা হয়েছে। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কিছু জায়গায় সন্তানকে Child না বলে Son বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ সন্তান মানে শুধু ছেলে, মেয়ে নয়। ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়ার তার হ্যামলেট নাটকে দেখিয়েছেন, বাবার মৃত্যুর পর মা একমাসের মধ্যে ক্লডিয়াসকে বিয়ে করলে সন্তান বলেন, ‘Frailty thy name is woman’। এই কথার মধ্য দিয়ে সমস্ত নারীকে অবজ্ঞা করা হলো। তাছাড়া সন্তান তার মাকে অবজ্ঞা করতে পেরেছে, কারণ মা হলেন নারী। সুতরাং শিল্প, সাহিত্যও কখনও কখনও জেন্ডার নিরপেক্ষ না হয়ে পুরুষতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে।
কিছু শব্দ কেবল নারীর জন্য
বেশ্যা-পতিতা:
বেশ্যা শব্দটি এসেছে ‘বৈশ্য’ শব্দ থেকে। বর্ণপ্রথার সময় হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বলা হতো বৈশ্য। সেখান এসেছে বাংলা বেশ্যা শব্দটি। যেসব মেয়ে টাকার জন্য কোন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কে জড়ায় তাদের বেশ্যা বা পতিতা বলা হয়। শুধু তাই নয়, যে মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সমাজে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করে, নিজের পছন্দমতো পোশাক পরে, অনেক রাত অবধি বাইরে থাকে তাদেরকেও বলা হয় বেশ্যা বা পতিতা। বেশ্যা, পতিতা এই শব্দগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। পতিতা বা বেশ্যা কেবল নারী হয়, আর যে ছেলেরা পতিতালয়ে যায় তাদের কোন নাম নেই।
পুরুষতন্ত্র নারীকে অবমাননা করার জন্য নানা ধরনের শব্দ সৃষ্টি করেছে এবং সেগুলোর ন্যায্যতা দিয়েছে। অথচ পুঁজিবাদী সমাজ যখন নারীর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না তখনই একজন নারী পতিতালয়ে যায়। এটা নারীর দোষ না, সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার সমস্যা।
নারীর সতীত্ব:
নারীকে সতী হতে হবে। সমাজ মনে করে, সতীত্ব পুরুষের জন্য নয়। তাই ছেলেরা বিয়ে করার সময় কুমারী মেয়ে খোঁজে।
কোন কোন ধর্মগ্রন্থও নারীর সতীত্ব বজায় রাখার পক্ষে। বাংলা অভিধান প্রণেতারাও ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করেননি। যেমন ‘সতী’ শব্দটির অর্থ বাংলা একাডেমীর অভিধানে এভাবে করা হয়েছে- সাধ্বী, পরিব্রতা, স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত নয় এমন, হিন্দু পুরাণের দক্ষ কন্যা, শিবানী, স্বামীর মৃত্যুতে সহগামিনী স্ত্রী। আর ‘সতীত্ব’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: যৌন পবিত্রতা, সতী স্ত্রীর ধর্ম।
সমাজের দৃষ্টিতে যৌন পবিত্রতা বা সতীত্ব শুধুমাত্র নারীর জন্যই প্রযোজ্য।
মেয়েলি, পুরুষালি
আমাদের সমাজে মেয়েলি আর পুরুষালি শব্দের অর্থের মধ্য দিয়েও নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত ভিন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। মেয়েলি কথাটি দিয়ে মেয়েদের আবেগী, যুক্তিহীন, কোমল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো জানান দেওয়া হয়। অপরদিকে পুরুষালি শব্দটি দিয়ে পৌরুষ, শক্তি, ক্ষমতা প্রকাশিত হয়। এর অর্থ হলো মেয়েরা আবেগ নিয়ে থাকবে, কোমল হবে। একারণে যখন কোন ছেলে কোমল আচরণ করে তখন তার স্বভাবকে মেয়েলি স্বভাব বলে উপহাস করে সমাজ।
এক ধরনের গালি দেওয়া অর্থে শালা বলা হয়। শালা মানে স্ত্রীর ভাই। স্ত্রীর ভাই আর গালি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এরকম নানা শব্দ কিংবা গালির মাধ্যমে পুরুষআধিপত্যের প্রকাশ ঘটে ভাষায়।
নটী, নর্তকী
নটী শব্দটি গালি দেওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। অথচ নটীর বিপরীতে আছে নট। নট গালি দিতে ব্যবহার করা হয় না। নৃত্য যার উপজীবিকা তাকে বলা হয় নর্তকী। ছেলের পেশা নৃত্য হলে সেটির কোন নাম নাই।
পূর্বপুরুষ
পূর্বপুরুষ নামের একটি শব্দ থাকলেও পূর্বনারী বলে অভিধানে কোন শব্দ নেই। তার মানে হলো, বংশের ধারক বাহক কেবল পুরুষরাই হবে। নারীর কোন স্থান নেই সেখানে।
বিধবা
স্বামী মারা গেলে মেয়েদের বলা হয় বিধবা আর স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর কোন নাম নেই। বিধবা নারী মানে অমঙ্গল, অকল্যাণ। এজন্য বিয়ে কিংবা কোন শুভ কাজের ক্ষেত্রে বিধবা নারীর উপস্থিতিকেও ঝামেলা মনে করা হয়।
প্রতিদিন যারা পাবলিক যানবাহনে চলাফেরা করেন তাদের প্রত্যেকেরই কমবেশি একটি অভিজ্ঞতা আছে, তা হলো- যেকোন ছোট কারণে একজন আরেকজনকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। এই গালিগুলো নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যৌন শব্দটিও এসেছে যোনি থেকে। যৌনতায় নারীর সক্রিয়তা সমাজ মেনে নেয় না। যৌনতা হয়ে দাঁড়ায় শুধুই পুরুষের সক্রিয়তার এলাকা, নারী সেখানে নিপীড়িত ও অনুষঙ্গ মাত্র।
ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সমাজে ভাষার মাধ্যমেও পুরুষের আধিপত্য বোঝা যায়। এই আধিপত্য আদিকাল থেকেই নারীর বিরুদ্ধে চলছে। কিছুটা পরিবর্তন ইদানিং দেখা গেলেও মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়নি। অভিধানের যে শব্দগুলো দিয়ে নারীকে ছোট করা হয় এবং পুরুষকে মহিমান্বিত করা হয় সেগুলো পরিবর্তন করা উচিত।
তিনি বলেন, শুধু নিরক্ষর না, অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষও নারীকে অবমাননা করার মতো শব্দ ব্যবহার করেন। তবে সম্প্রতি এদেশে জেন্ডারের ধারনা গড়ে উঠেছে কিছুটা। আর নারীরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কারনে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।’
ধর্মীয় শ্লোক কিংবা শব্দ
ধর্মীয় মতাদর্শের ভাষাও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণের পক্ষপাতী। যেমন: স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। হিন্দুধর্মে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের যে কথামৃত আছে সেখানে সন্তান বলতে কেবল পুত্রকে বোঝানো হয়েছে। কন্যা সন্তানের কথা উল্লেখ করা হয়নি। যেমন-
মাতৃভক্তি হয় অটুট যত, সেই ছেলে হয় কৃতি ততো
পিতায় শ্রদ্ধা ও মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্যপ্রাণ
ধর্মগ্রন্থ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘ধর্মগ্রন্থেও বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে নারীকে ছোট করা হয়েছে। রামায়ণে রামচন্দ্র বলেছেন, ‘দেশে দেশে গেলে সীতা পাব, কিন্তু লক্ষ্মণ পাব না’। অর্থাৎ যেকোন দেশে সীতার মতো অনেক স্ত্রী পাওয়া যায়, কিন্তু লক্ষ্মণের মতো ভাই পাওয়া যায় না।’
Blogger দ্বারা পরিচালিত.