কোথায় মাতৃভাষা? পুরুষই তো ভাষাও নিয়ন্ত্রণ করে


Odd বাংলা ডেস্ক: সমাজে পুরুষতন্ত্রের যে আধিপত্য, ভাষা সেই আধিপত্যের জমিনকে সুদৃঢ় করেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অন্য অনেক কিছুর মতো ভাষাও নারীর উপর আধিপত্য সৃষ্টি করে। ভাষা হয়ে দাঁড়ায় পুরুষতন্ত্রের দাস। ভাষাও নারীকে করে অবমাননা।
হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ও তার নিরিখে নির্মিত ভাষা নারীকে নানাভাবে অবদমন করছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রাখতে ভাষা একটি মুখ্য শক্তি হয়ে উঠেছে।
ভাষার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মানুষের মুখের ভাষাটাই সংযোজন বিয়োজনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে বই পুস্তকে সংরক্ষণ করেছেন ভাষা বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানীরা। বইয়ের ভাষা নানা সময়ে সংশোধন বা পরিমার্জন করা হয়েছে। তাছাড়া ভাষা নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি বেশিরভাগ সময়ই থেকেছে উপেক্ষিত।
ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে আর নারীকে করেছে হেয়। পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার অসংবেদনশীল অনেক শব্দ, বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচন সংযোজন করা হয়েছে। যেমন ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও বা পৃথক হয় তবে নারীর কারণ’ কিংবা ‘ঝিঁকে মেরে বৌকে শেখানো’। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই প্রবাদগুলোর সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত।
ফলে ছোটবেলাতেই একজন শিশুর মনে ছেলে ও মেয়ে সম্পর্কিত একটি ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ছেলে হবে শ্রেষ্ঠ আর মেয়ে হবে পতি বা পুরুষের দাস। ছেলে শিশুর মননে গেঁথে যায়, সে মেয়েদের অবদমিত করবে। আর মেয়ে শিশু ভাবে তাকে এই সমাজের সমস্ত অসঙ্গতি মেনে নিতে হবে। পুরুষ যেভাবে তাকে দেখতে চাইবে সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। এই ধরনের চিন্তাগুলো ছোটবেলা থেকেই ভাষার মাধ্যমে শিশুর চিন্তায় ও মননে গেঁথে যায়। তাই বড় হয়েও ছেলেরা মেয়েদের সম্মান করতে শেখে না।
এখন সমাজে যেসব গালিগালাজ প্রচলিত, সবগুলো নারীকে উদ্দেশ্য করেই। জেন্ডার অসংবেদনশীল এসব প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, শ্লোক ও শব্দগুলো যদি শুধুমাত্র বইপুস্তকে সংরক্ষণ করা থাকতো এবং ভাষা নিয়ে যারা কাজ করছেন বা যাদের এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আছে তারাই কেবল এই সংরক্ষিত বইগুলো পড়তো তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হতো না। তাতে একাডেমিক পড়াশুনা করতে গিয়ে অন্তত জেন্ডার অসংবেদনশীল এই ভাষাগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতো না এবং সমাজে অবলীলায় এসব শব্দের ব্যবহার কমে যেত।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৫টি বইয়ের মোট ৩৪৬৪ পৃষ্ঠার আধেয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তকের ভাষায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যেমন পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন জায়গায় ‘শিক্ষার্থী’ না লিখে ‘ছাত্রছাত্রী’ লেখা হয়েছে। আবার বিভিন্ন বইয়ে ‘কৃষক’ শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে শিশুরা ধরে নেবে কেবল ছেলেরাই কৃষিকাজ করে। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের একটি বিরাট অংশ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত এই বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়নি।
এই গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক বইয়ে মেয়েদের নামের আগে ‘মিসেস’ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নারীর স্বতন্ত্রতা হারিয়ে গেছে। যেমন তাকে বলা হচ্ছে মিসেস মাসুদ। অর্থ্যাৎ স্বামীর পরিচয়ে নারী পরিচিত হবে। আবার পাঠ্যপুস্তকের অনেক জায়গায় মহিলা শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জেন্ডার নিরপেক্ষতা বজায় থাকেনি। মহিলা অর্থ ‘যে মহলে থাকে’। এই ধরনের শব্দগুলো পাঠ্যপুস্তকেই শিখছে শিশুরা।
‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই পরিচালিত হয় পুরুষতন্ত্র দিয়ে। কিছু কিছু শব্দ আছে, তা শুধুই নারীর জন্য। যেমন অসতী, পতিতা এগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। আবার জেন্ডারের দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইংরেজি ব্যাকরণের Person বাংলা ব্যাকরণে ‘ব্যক্তি’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বাংলা ব্যাকরণে Person এর বাংলা হলো ‘পুরুষ’- উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ ও নামপুরুষ।
আবার কিছু কিছু শব্দ অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক। যেমন ‘বাপ কা বেটা’- এই শব্দের মধ্য দিয়ে পুরো সুনাম বা খ্যাতি চলে যায় বাবার কাছে। মানে ছেলে ভাল কিছু করলে তখন সে হয় বাবার ছেলে। আর খারাপ করলে হয় মায়ের মতো। যেমন- চোরের মায়ের বড় গলা।’
শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে
ভাষা সমাজেরই একটি অংশ। সমাজ যখন জেন্ডারকে গুরুত্ব দেয় না তখন শিল্প, সাহিত্যের ভাষাও সংবেদনশীল হয় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘নারী জাতি যুক্তি বুঝে না, তারা সর্বক্ষেত্রে কেঁদে জিততে চায়’। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বিরাট অবদান থাকলেও এই বাক্যটির মাধ্যমে নারীর মেধাকে তুচ্ছ করা হয়েছে।
আবার বাংলা সাহিত্যের অনেক জায়গায় প্রকৃতির কোমলতার সাথে নারীর রূপ ও সৌন্দর্যকে তুলনা করা হয়েছে। ফলে নারীর রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা আমাদের সবার মাথায় আসে যে নারী হবে সুন্দর, কোমল। অথচ প্রকৃতির কোমলতার সাথে পুরুষের রূপকে তুলনা করে সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। এর অর্থ দাঁড়ায়, কেবল নারীকেই হতে হবে কোমল ও নমনীয়।
শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক সাহিত্যে নারীর অবস্থানকে খাটো করা হয়েছে। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কিছু জায়গায় সন্তানকে Child না বলে Son বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ সন্তান মানে শুধু ছেলে, মেয়ে নয়। ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়ার তার হ্যামলেট নাটকে দেখিয়েছেন, বাবার মৃত্যুর পর মা একমাসের মধ্যে ক্লডিয়াসকে বিয়ে করলে সন্তান বলেন, ‘Frailty thy name is woman’। এই কথার মধ্য দিয়ে সমস্ত নারীকে অবজ্ঞা করা হলো। তাছাড়া সন্তান তার মাকে অবজ্ঞা করতে পেরেছে, কারণ মা হলেন নারী। সুতরাং শিল্প, সাহিত্যও কখনও কখনও জেন্ডার নিরপেক্ষ না হয়ে পুরুষতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.