মধু মন্ডলের চিঠি: যার বানানের আতঙ্কে স্কুল খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট


বিক্রম পাঠক: আমার ঠাকুরদার কাছে শোনা গল্প এটা। তিনি বাংলা সন বলেছিলেন ১২৭২। মানে ইংরাজি সালের হিসাবে ১৮৬৬। মালদা জেলার বর্তমানে যেখানে মানিকচক থানা সেটাকে তখন দিয়ারা বলা হত। যার অনেকটা অংশ এখন গঙ্গা বক্ষে, ভাঙনে সব চলে গিয়েছে।   ইংরেজ আমল। খুব দরিদ্র অঞ্চল ছিল এটা।   মানিকচকের মথুরাপুর এলাকাতে একটা নীলকুঠি ছিল। নীলচাষীরা কর দিতে সেই কুঠিবাড়িতে যেতেন। ইংরেজ সাহেবরা থাকতেন সেই কুঠিতেই। এই অঞ্চলটা তখন বিহারের পুর্নিয়া সাব ডিভিসনের অন্তর্গত ছিল। আর এখানেই ঘটে গিয়েছিল বাংলা ভাষার এক বিপ্লব। হ্যাঁ বিপ্লবই বটে। কারণ এখানেই মধু মন্ডল নামে এক জনৈক লিখেছিলেন ভয়ঙ্কর কিছু বানান।  

ঔপনিবেশিক বাংলায় দেশের জনগণ নানা উপদ্রবের শিকার ছিল। ঔপনিবেশিক সরকার, জমিদার, নীলকর প্রমুখের উৎপাতে সাধারণ জনগণের ছিল ত্রাহি ত্রাহি দশা। ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকত আঁতাত। সেই অত্যাচারের বিহিত করতে ভুক্তভোগী প্রায়ই রাষ্ট্রের সুবিবেচনার কাছেই আবেদন জানাত। সেসময়ই মধু মন্ডল তার দুঃখের কথা জানাতে একটা চিঠি লিখেছিল। 

তাঁর দরখাস্ত মোতাবেক সেখানকার নায়েব দারোগা নীলকান্ত রায় পুলিশ ও কর্মচারীদের নিয়ে তাঁকে মারপিট করে টাকা আদায় করেন। মধু তখন নীলকান্তর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন সাহেব দারোগা মামলার ভার পেয়ে রুক্মীনীকে সতর্ক করে দেন, আর রুক্মীনীও নানা বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করতে থাকেন, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। এমতাবস্থায় মামলাটি সাবইনস্পেক্টর মহোদয়ের কাছে ন্যস্ত করার জন্য মধু খোদ জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরখাস্ত করেন।
সেই চিঠির হুবহু রূপ তুলে ধরা হল। 


মহামহিম শ্রীযুক্ত জাইন্ট মাজিষ্ট্রেট সাহেব বরাবরেছ
———————————————————————————–
দরখাস্ত শ্রীমধুমন্ডল মহামদ সাহি নিবেদন এই থানা হরজিনগর তাবত পুলীস আমলা গন জোটবদ্ধ হইয়া আমার বাটীর পর অনধিকার প্রবেস পূর্ব্বক আমাকে পাকড়া করিয়া থানার গারদে কএদ রাখীয়া ৭ টাকা জরীমানা করিয়া লওয়া ও চুরি মোকদ্দমা গোপন করা ইত্যাদী মোকদ্দমা থানা কোতওয়ালীর দারোগার দ্বারা তদন্তের প্রার্থনায় আমী হুজুরে দরখাস্ত করায় মোকদ্দমার তদারক জন্য নাএব  দারোগা মহাসয় নাজানাইয়া ঐ মোকদ্দমার তদারক জন্য এ থানার সাহেব দারোগার নিকট পরওয়ানা রাখিয়াছেন ধর্মাবতার উক্ত সাহেব দারগার ঐ মোকদ্দমার পক্ষে আমী নিতান্ত নারাজ তাহা দ্বারা মোকদ্দমার উচীত তদারক হইবেক না কারন আমার আসামী উক্ত থানা হরজিনগরের নাএব দারোগা রুক্মীনী কান্ত রায় ঐ সাহেব দারোগার নিজের পালিত লোক এবং আমি এইরূপ তাহার নামে দরখাস্ত করায় সাহেব দারোগা সাহেব তাঁহাকে এই সংবাদ অগ্রেদিয়া সাবধান করিয়া দেওয়াতে আসামী উক্ত নাএব দারোগা প্রভৃতি আমার মানীত সাক্ষীসাবুদ গনের অগ্রে ধরিয়া সাসন করিতেছেন এবং আমী এই দরখাস্ত করায় উক্ত নাএব দারোগা আমার পর অত্যন্ত রাগত হইয়া আমাকে সর্ব্বদা নানা প্রকার উৎপাত করিতেছেন তাহার উৎপাতের যন্ত্রনায় কোন মতে ভিটায় থাকিতে পারিনা একারন দরখাস্ত করিয়া প্রার্থীত যে আমার এই মোকদ্দমার তদারক জন্য থানা কোতওয়ালীর সবইনিসপেকটার মহাসএর নামে পরয়ানা প্রচার করিতে আজ্ঞা হয় 



এই ঘটনার পরেই নাকি জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট সে সময় পুর্নিয়া সাব ডিভিসনে থাকা এক শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠান পরিদর্শনে। এবং জানতে চাওয়া হয় এই অঞ্চলে কটা স্কুল। ফিরে গিয়ে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে খবর দেন যে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। তারপরেই অবিলম্বে একটি স্কুল তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। 

তথ্যসূত্র: গম্ভীরা পত্রিকা (1962 সংখ্যা)
                 আর আমার ঠাকুরদা 
                
Blogger দ্বারা পরিচালিত.