পেপে মুজিকা: পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব রাষ্ট্রপতি, সম্বল বলতে একটা সাইকেল আর এক চালার ঘর



Odd বাংলা ডেস্ক: গত সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে একটা সাড়া জাগানো ভাষণ দিয়েছিলেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। পশ্চিমা ভোক্তাবাদের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন যে, আমরা এখন উপাসনা করি বাজার-ঈশ্বরের। লাতিন আমেরিকার আরও অনেক দেশের মতো উরুগুয়েও লড়ছে পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গাঁজাকে বৈধতা দেওয়ার কারণেও বেশ আলোচিত হয়েছে উরুগুয়ে।

লাতিন আমেরিকার এই দেশটির প্রেসিডেন্ট অবশ্য বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন আরও আগে। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে। প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত বাড়ির বিলাসবহুল জীবনযাপনের পথ পরিত্যাগ করে তিনি এখনো বসবাস করছেন নিজের একটা সাধারণ বাড়িতে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্ত বেতনের ৯০% অর্থই মুজিকা দান করে দেন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। তবে পুরো বিশ্ব বললেও নিজেকে কিন্তু গরিব ভাবেন না মুজিকা। আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে গরীব হচ্ছে তারাই যারা খুবই বেশি বেশি চায়। কারণ যাদের চাওয়া অনেক বেশি, তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না।’

সন্দেহ নেই উরুগুয়ের এই রাষ্ট্রপ্রধান একজন কৌতুহল জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। তবে শুধু বর্তমানেই না, পেপে মুজিকার অতীত ইতিহাসটাও বেশ চমকপ্রদ। ধনসম্পদের প্রতি আকর্ষণহীন এই ব্যক্তি একসময় ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতেন। সেটাও করতেন মাঝেমধ্যেই। একা একা না অবশ্য। হোসে মুজিকা ছিলেন টুপামারোস আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত স্থায়ী ছিল উরুগুয়ের শহরভিত্তিক এই বিদ্রোহ। ‘টুপামারোস জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে সংগঠিত হয়েছিলেন মুজিকা, রাউল সেনডিক, জর্জ জাবালজার মতো শহুরে গেরিলারা।

এই ডাকাতি তারা করতেন সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্য। ব্যাঙ্ক লুটের টাকা তারা বিলিয়ে দিতেন গরীবদের মধ্যে। খাদ্য পরিবহনকারী ট্রাক লুট করে সেটা বিলিয়ে দিতেন অনাহারীদের মাঝে। ১৯৬৯ সালে যে কারণে টাইমস ম্যাগাজিনে তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘রবিন হুড গেরিলা’ হিসেবে।

মুজিকারা এই কর্মপন্থার নাম দিয়েছিলেন সশস্ত্র প্রচারণা। হাতে অস্ত্র থাকলেও সেটা দিয়ে খুনখারাবি করার চাইতে প্রচার-প্রচারণার দিকেই মনোযোগ ছিল টুপামারোস বিদ্রোহীদের। ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে তারা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিতেন সন্দেহজনক গণবিরোধী দলিলপত্র। জনপ্রিয় ফুটবল খেলা চলার সময় রেডিও স্টেশন দখল করে তারা চালাতেন তাদের প্রচারণা। তাঁদের অনেক অপারেশনই সম্পন্ন হয়ে যেত একটি গুলিও না ছুঁড়ে। ১০০ জনেরও কম মানুষ নিয়ে তাঁরা সেসময় কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকদের মনে।

সরকারের পাল্টা গেরিলা আক্রমণও শুরু হয়েছিল দ্রম্নতই। আর আস্তে আস্তে তারা এই টুমপামারোসকে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। মুজিকা নিজেও হয়েছিলেন এমন আক্রমণের শিকার। ১৯৭০ সালের মার্চে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়টি গুলি খেয়েছিলেন উরুগুয়ের বর্তমান এই রাষ্ট্রপতি। সুস্থ হতে লেগেছিল প্রায় এক বছর। সেসময়ই তাঁকে জেলে বন্দি করা হয় অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে। প্রায় এই সময় থেকেই এই শহুরে আন্দোলন কিছুটা দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।

উরুগুয়ের এই রবিনহুড গেরিলারা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বেশি পরিচিত ১৯৭০ সালেই ঘটা আরেকটি ঘটনা দিয়ে। সে বছরের আগস্টে টুমপামারোস গেরিলারা বন্দী করেছিল বেশ কয়েকজন বিদেশীকে। আর মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করেছিল তাদের কারাবন্দী সদস্যদের মুক্তি। সরকার আলোচনা করতে রাজি না হওয়ায় বন্দী এক আমেরিকানকে হত্যা করেছিল একেবারে ঠাণ্ডা মাথায়। এই সময়ের আগ পর্যন্ত এমএলএন-এর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল সশস্ত্র প্রচারণা আর পুলিশের সঙ্গে খুবই ছোটখাট সংঘর্ষের মধ্যে। কিন্তু এরপর শুরু হয় অপহরণ। এমনকি কখনো কখনো বোমাবাজির মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর একটা কারণ হতে পারে, নেতৃত্বের পরিবর্তন। পরবর্তী সময়ের তরুণ, অতি প্রগতিশীল ও অতি সহিংস নেতারা উরুগুয়ের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন ‘শ্রেণীশত্রু’ খতমের দিকে। ক্রমবর্ধমান সহিংসতার সঙ্গে পরবর্তীতে যোগ হয় গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জেল পালানোর ঘটনা। সরকার এই ‘উপদ্রব’ নির্মূল করার জন্য প্রয়োগ করে সর্বশেষ অস্ত্র: সেনাবাহিনী।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন চালিয়ে ‘রবিহ হুড গেরিলাদের’ পিষে ফেলা হয়। ১৯৭২ সাল নাগাদ প্রায় নির্মুলই হয়ে যায় টুমপামারোসরা। আর ১৯৭৩ সালের জুনে এই সেনাবাহিনীই ক্ষমতা গ্রহণ করে একটি ক্যুয়ের মাধ্যমে। যার পরিণতি হিসেবে জেলে বন্দী মুজিকাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ বিভীষিকা। তাঁকেসহ মোট নয়জন টুপামারোসকে বিশেষভাবে সনাক্ত করে ছুঁড়ে ফেলা হয় সলিটারি সেলে। অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৫ সালের মার্চে গণতান্ত্রিক সরকার ফিরে আসার পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। তার আগে ইট-লোহার বন্দীশালায় তাঁদের কাটাতে হয়েছে ১৩টি বছর।



জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর খুব দ্রুতই জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন মুজিকা। সিনেটর, মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর এখন তিনি রাষ্ট্রপতি। সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘এল পেপে’ নামে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে পুরোনো দিনের সেই রবিন হুড গেরিলা ভাবমূর্তিও হয়তো একটা বড় অবদান রেখেছে। শুরুর দিকে তাদের কর্মকাণ্ডের পেছনে মতাদর্শটা ছিল অন্যরকম। তাঁরা কারো উপরে কোনো কর্তৃত্ব-কাঠামো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করতেন না। তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো সামাজিক বৈষম্য-অনায্যের প্রতিকার করার জন্য। তাঁরা যখন একটা ক্যাসিনো লুট করে সেটার টাকা বেতন না পাওয়া শ্রমিকদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন, তখন অনেকে বিস্মিত হয়ে যেতেন, অনেককে সেটা অনুপ্রাণিতও করত।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.