শকুন্তলা দেবী : কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুত গণিত সমাধানকারী এক মা!


Odd বাংলা ডেস্ক: আমাদের চারপাশে অনেক বৈচিত্র্যময় মানুষের বসবাস। সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকেই কোনো না কোনো বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তবে মানুষের প্রয়োজন সেই বিশেষ ক্ষমতাকে শনাক্ত করা ও তা পরিমার্জন করা। আর এজন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা।
আজকে এমনই একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষের কথা বলব, যিনি তার কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সারাবিশ্বের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন। শুধু তাই নয় তাকে বলা হয়েছে ‘মানব ক্যালকুলেটর’ অথবা ‘মানব কম্পিউটার’।
বলছি ভারতের প্রসিদ্ধ গণিতবিদ, লেখিকা ও সমাজকর্মী শকুন্তলা দেবীর কথা। ৪ নভেম্বর, ১৯২৯ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পরিবার ছিল রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ। কিন্তু তার বাবা ঐতিহ্যগতভাবে পুরোহিত হতে চাননি। এ কারণে তিনি কোনো এক সার্কাস দলে চাকরি করতেন।
শকুন্তলার বয়স যখন মাত্র ৩ বছর তখনই বাবার কাছে সার্কাসের তাবুর পাশে বসে তাস খেলার বেশ কিছু কৌশল শেখা হয়েছিল। তাসের খেলা একবার দেখলেই শিখে ফেলত শকুন্তলা। এভাবে তাসের সবগুলো ম্যাজিক যখন আয়ত্ত করেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। 
এরপর সে বাবার কাছে নম্বরের খেলা শেখা শুরু করে। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ৫ বছর বয়সেই আয়ত্তে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এতে সে হাতের আঙ্গুল গুণত না। শুধু মুখে মুখেই সমাধান করে দিতে পারত। এসব শেখার জন্য তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার দরকার হয়নি।
শকুন্তলার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন সে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের বিশেষ কৌশল প্রদর্শন করে। এরপর বাবা সার্কাসের চাকরি ছেড়ে দেন। পরিকল্পনা করেন শকুন্তলার প্রতিভা বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করবেন। পরিকল্পনা মোতাবেক শকুন্তলাকে নিয়ে বাবা লন্ডন চলে যান। লন্ডনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বেশকিছু পুরস্কার পায় শকুন্তলা।
১৯৬০ সালে শকুন্তলা দেবী ভারতে ফিরে আসেন ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্বামীর নাম ছিল পরিতোষ ব্যানার্জী। পেশায় ছিলেন আইএএস অফিসার। সাংসারিক নানা আদব-কায়দা ভালোভাবেই পালন করছিলেন শকুন্তলা। সংসারও কাটছিল ভালোভাবেই। কিন্তু কয়েক বছর পর তার সাংসারিক জীবনের ছন্দপতন ঘটতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন তার স্বামী একজন সমকামী। তবে শকুন্তলা সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে দেখেননি। তবুও ১৯৭৯ সালে সংসার ভেঙে যায়।
সংসার ভাঙলে শকুন্তলা দেবী কখনো ভেঙে পড়েননি। তীব্র মনোবল ও সাহস নিয়ে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন। তিনি মুম্বাই ও তেলেঙ্গানায় ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেব নির্বাচন করেছিলেন। যদিও নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন।
নির্বাচনে হারলেও প্রতিভা প্রকাশে কখনো হার মানেননি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শকুন্তলা গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, পাজল এবং মানবজীবনের নানাবিধ সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বেশকিছু বই লিখেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে– ‘অ্যাস্ট্রোলজি ফর ইউ, ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড অফ নাম্বারস, ম্যাথ অ্যাবিলিটি : অ্যাওয়াকেন দ্য ম্যাথ জিনিয়াস ইন ইওর চাইল্ড, পারফেক্ট মার্ডার, পাজল টু পাজল ইউ, দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হেমোসেক্সুয়ালস’ ইত্যাদি।
শকুন্তলা দেবী বিশ্বের ৫০টিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করে তার গণিতের প্রতিভা ছড়িয়েছিলেন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নাট্যমঞ্চে তার গণিতের প্রতিভা প্রদর্শন করেন। এভাবেই একসময় টিভিতেও তার স্থান হয়। তার গণিতের অসামান্য দক্ষতায় ব্রিটিশ মিডিয়া বিস্মিত হয়েছিল।
৫ অক্টোবর, ১৯৫০ সালে বিবিসি মিডিয়ার প্রখ্যাত হোস্ট লেসলি মিচেল, শকুন্তলা দেবীকে খুবই কঠিন একটি গণিত প্রশ্ন করেন। শকুন্তলা খুব স্বল্প সময়ে মুখে মুখেই তার উত্তর বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু শকুন্তলার উত্তর মিচেলের উত্তরের সাথে মেলেনি।
উত্তর না মিললেও শকুন্তলা তার উত্তরের পক্ষেই ছিলেন। তখন লেসলি মিচেল মূল উত্তর ভালোভাবে দেখতে থাকেন। শকুন্তলার মুখে মুচকি হাসি ফোটে। না কাউকে ছোট করতে নয়, হয়তো স্বভাবসুলভ হাসি ছিল। পরক্ষণেই জানা যায় লেসলি মিচেলের কাছে থাকা মূল উত্তরটিই ভুল ছিল! এই ঘটনার পর থেকেই তাকে মানব কম্পিউটার আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। 
১৯৭৭ সালে শকুন্তলা দক্ষিণ মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১ সংখ্যার ২৩তম মূল বের করতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ৫০ সেকেন্ড। আর বিস্ময়কর হলেও সত্য একই প্রশ্নের উত্তর বের করতে UNIVAC 1101 কম্পিউটার সময় নিয়েছিল ১ মিনিট!
১৯৮০ সালের ১৮ জুন আরেকটি বিস্ময়কর গণিতের সমাধান করেন শকুন্তলা। তেরো অঙ্কের দুটি সংখ্যার গুণ করতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ২৮ সেকেন্ড। গুণটি একবার সমাধানের চেষ্টা করবেন কী? গুণটি ছিল ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০×২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯। ১৯৮২ সালে শকুন্তলা দেবী গিনেস বুকে প্রতিভার দ্বারা নাম লেখিয়েছিলেন। এছাড়াও অনেকগুলো পুরস্কার ও সন্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
সমাজের অসহায় দুস্থ মানুষদের জন্য শকুন্তলার মন প্রতিনিয়ত কাঁদত। যে কোনো দানের কাজে সর্বাগ্রে শকুন্তলার নাম থাকত। বিশেষ করে বস্তি এলাকার শিশুদের জন্য তার সাহায্যের হাত সবসময়ই খোলা থাকত। এছাড়াও গরিব পরিবারের মেয়েদের নানাভাবে সাহায্য করতেন শকুন্তলা দেবী।
নানা বিষয়ে প্রতিভার পরিচয় প্রদর্শন করে, ২০১৩ সালে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শকুন্তলা। সেখানে প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার কথা বলেছিলেন। চিকিৎসা চলাকালীন তার হৃদপিণ্ডও আক্রান্ত হয়। 
২১ এপ্রিল, ২০১৩ সালে এই মানব কম্পিউটার ও মানব ক্যালকুলেটরের কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। 
Blogger দ্বারা পরিচালিত.