বিশ্বের কিছু বিপজ্জনক বিমানবন্দর, যেখান থেকে একাধিকবার প্রাণ হাতে ফিরে এসেছেন বহু পাইলট
Odd বাংলা ডেস্ক: বিশ্বের এমন অনেক বিমানবন্দর রয়েছে, যেখানে বিমান ওঠানামার সময় প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। পাইলটের একটু ভুলেই হয়ে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কোনও বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোট কোথাও রানওয়ে উঁচু পাহাড় ঘেরা বা সমুদ্রের খুব কাছে বা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে। আজকের প্রতিবেদনে আপনাদের জন্য রইল সেইসব ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক বিমানবন্দরের খোঁজ।
১) তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর, নেপাল- বিশ্বের বিপজ্জনক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর। মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার-উতরাইসের মতোই এখানে বিমান অবতরণ করাও একইরকম কঠিন। ঝড়ো হাওয়া, ঘন মেঘের কারণে এখানে প্লেনের গতি নিয়ন্ত্রণ রাখা খুব কঠিন। ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিস্ট্রি টেলিভিশন চ্যানেল একে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফ্লাইট প্রায়ই দেরি হয় এবং প্রয়োজনে বিমানবন্দর বন্ধও করা হয়। এখানে উন্নত ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমও নেই। নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ আলোর ব্যবস্থাও। বৈদ্যুতিক আলো থাকলেও তা পরিমাণে অনেক কম। ঝুঁকিপূর্ণ এই বিমানবন্দরে ঘটেছে অনেক দুর্ঘটনাও। মারাও গেছেন অনেকে। এই বিমানবন্দরের নির্মাণকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী এডমন্ড হিলারি। তার শেরপা ছিলেন শেরপা তেনজিং নোরগে। এডমন্ড হিলারি নিজের টাকা দিয়ে জমি কেনেন এই বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য। বিমানবন্দরটির নেপালের পূর্বাঞ্চলের সাগর মাথা অঞ্চলের লুকলা শহরে অবস্থিত। তাই প্রথমে এর নাম ছিল লুকলা বিমানবন্দর। পরে ২০০৮ সালে তাদের সম্মানে এই বিমানবন্দরের নতুন নাম রাখা হয় তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দর।
২) প্রিন্সেস জুলিয়ানা বিমানবন্দর, নেদারল্যান্ডস- এই বিমানবন্দরটি অবস্থিত ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্টমার্টিনের সৈকতের পাশে। ক্যারিবিয়ানের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর এটি। সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের একেবারে মাথার ওপর দিয়ে বিমানকে ওঠানামা করতে হয়। বিপজ্জনক এলাকা লেখা থাকলেও পর্যটকরা আনন্দ নিতে এখানে ভিড় জমান আর নানা সময়ে ঘটে যায় নানা দুর্ঘটনা। বিমানবন্দরটি ১৯৪২ সালে যখন নির্মাণ করা হয় তখন বড় বিমান অবতরণের কথা মাথায় রাখা হয়নি। কারণ, তখন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর তখন যাত্রী পরিবহনের চেয়েও যুদ্ধবিমানে গোলাবারুদ পরিবহন করা হত। রানওয়েটি ছোট, মাত্র ৭,১৫০ ফুট, যা বড় বা ভারী বিমান অবতরণের জন্য নিরাপদ নয়। তবে এখন বড় ও ভারী বিমানও এখানে উড়ান ও অবতরণ করে, যার ফলে পাইলটদের বেশ ঝুঁকি নিতে হয়।
৩) পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ভুটান- বিরাট পর্বত শৃঙ্গের মাঝে ছোট্ট একটা সমতল ভূমিতে ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারো। আশপাশের পাহাড়গুলোর উচ্চতা ১৮ হাজার ফুট পর্যন্ত। পার্বত্য এলাকায় আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ায় বিমানবন্দরটিতে উড়ান চলাচল প্রায়শই বিঘ্নিত হয়। এই কারণেই বিমানবন্দরটি বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম বিমানবন্দরের মধ্যে অন্যতম হিসাবে ধরা হয়। সাধারণত রানওয়েতে বিমান নামে সোজা, আস্তে আস্তে গতি আর উচ্চতা কমিয়ে। কিন্তু এই বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করতে হয় এঁকেবেঁকে আচমকাই। অভিজ্ঞ পাইলট ছাড়া এখানে বিমান উড়ান-অবতরণ করা খুবই কছিন।
৪) গিসবর্ন বিমানবন্দর, নিউজিল্যান্ড- বিপজ্জনক বিমানবন্দরের তালিকায় রয়েছে নিউজিল্যান্ডের গিসবর্ন বিমানবন্দর। এর অন্যতম একটি কারণ হল রানওয়ের মাঝখান দিয়েই চলে গিয়েছে একটি রেললাইন। সেখানে ট্রেন চলাচল করে। শুধু এ কারণেই এটি অন্যান্য সব বিমানবন্দর থেকে একেবারে আলাদা।বিমানবন্দরটির মোট আয়তন প্রায় ১৬০ হেক্টর। ঘাসের রানওয়ে তিনটি আর পাকা রানওয়ে একটি। আর সেই মূল রানওয়েরই বুক চিড়ে বেরিয়ে গেছে ‘পামারস্টোন নর্থ গিসবর্ন রেলওয়ে লাইন’। তাই যখনই বিমান আর রেলগাড়ি কাছাকাছি সময়ে চলে আসে, তখন যেকোনও একটি বন্ধ রাখা হয়। আর এই ব্যবস্থাপনার বিষয়টি শুনতে যেমন সহজ, কাজে মোটেই তেমন সহজ নয়। বিমানবন্দরটি অবস্থিত নিউজিল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গিসবর্ন শহরে।
৫) মেডেইরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পর্তুগাল- এই বিমানবন্দরটি অবস্থিত পর্তুগালের সান্তাক্রুজে।মেডেইরা বিমানবন্দরের একপাশে উঁচু পাহাড়, আরেক পাশে সমুদ্র। পাহাড়ের পাদদেশে সমুদ্রে অসংখ্য পিলারের ওপর তৈরি এ বিমানবন্দরের রানওয়ে। আর তাই এই বিমানবন্দরের রানওয়ে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। একেবারে বাজপাখির মতোই নামতে হয় বিমানকে। অভিজ্ঞ পাইলটদের জন্যও বিমান অবতরণ করাটা খুব কষ্টসাধ্য। অনেক অভিজ্ঞ পাইলটও এখানে বিমান চালনায় হিমশিম খান। বর্তমানে এর রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৫২৪৯ ফুট। বড় ও ভারী বিমান নিরাপদে অবতরণ করতে হলে প্রয়োজন ১০ হাজার ফুট রানওয়ে। আর সাগরের ওপর পিলার দিয়ে তৈরি রানওয়ে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু এদিক সেদিক হয়ে গেলে বিমান রানওয়ে থেকে অবতরণ করবে সাগরে।
৬) কোর্চেভেল বিমানবন্দর, ফ্রান্স- বিমানবন্দরের রানওয়ে সমতল থাকার কথা। কিন্তু উঁচু-নিচু রানওয়ের কথা শুনেছেন কখনো! ফ্রান্সের কোর্চেভেল বিমানবন্দর তেমনি এক ভয়ংকর রকমের উঁচু-নিচু রানওয়ের বিপজ্জনক বিমানবন্দর। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ হাজার ফুট উঁচুতে ফ্রান্সের আল্পসে অবস্থিত। বিমানবন্দরটির রানওয়ের চারপাশ ঢাকা থাকে বরফে। ঝপ করে রানওয়েতে নেমে যাওয়া বিমানের গতি কমাতে না পেরে প্রায়ই বিমান ঢুকে যায় চারপাশে তুষারের মধ্যে। তা ছাড়া এই বিমানবন্দরে নেই কোনও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা। রানওয়েতে নেই কোনও ধরনের আলোর ব্যবস্থা। রয়েছে মাত্র একটি রানওয়ে। আল্পস পর্বতমালা পার হয়ে সতর্কতার সঙ্গে অসমান এই ছোট রানওয়েতে অবতরণ করতে পাইলটদের অনেক কসরত করতে হয়। তার সঙ্গে যদি যোগ হয় মেঘ আর ঘন কুয়াশা, তাহলে এর ঝুঁকির কথা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। এই এলাকাটি বিখ্যাত স্কি এরিয়া হিসেবে। বিমানগুলো ওঠানামা করে শুধু পর্যটকদের জন্য। এই বিমানবন্দরে ছোটখাটো বিমান অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে।
৭) টনকনটিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হন্ডুরাস- বিমানবন্দরটি চালু হয় ১৯৩৪ সালে। হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপাতে অবস্থিত এই বিমানবন্দর। অসামরিক বিমানের পাশাপাশি সামরিক বিমানও চলাচল করে এখান থেকে। পর্বতঘেরা ও ছোট রানওয়েবিশিষ্ট এই বিমানবন্দরটিকে পৃথিবীর অন্যতম ঘাতক বিমানবন্দর হিসেবে বলা হয়ে থাকে। নানা ধরনের বাধা পার হয়ে এই বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয়। যেমন অবতরণ করতে হলে বিভিন্ন পর্বতের মাঝখান দিয়ে উড়ে আসতে হয়, বিমানকে কিনারা দিয়ে ৪৫ ডিগ্রি বাঁক নিতে হয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া তীব্র বাতাস তো রয়েছেই। উপত্যকার ওপর অবস্থিত এই বিমানবন্দরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩২৯৪ ফুট ওপরে।
জিব্রাল্টার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জিব্রাল্টার |
৮) জিব্রাল্টার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জিব্রাল্টার- স্পেনের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ছোট একটি ব্রিটিশ এলাকার নাম জিব্রাল্টার। এখানেই রয়েছে এই বিমানবন্দর। মূলত এলাকাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সমতল ভূমি না থাকায় এর চার লেনের হাইওয়ের ওপর দিয়ে রানওয়ে বানানো হয়েছে। এই সড়কে যান চলাচল করে প্রতিনিয়ত। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটি কিন্তু সত্যি। এই হাইওয়েটি উইনস্টন চার্চিল অ্যাভিনিউ থেকে স্পেন ও জিব্রাল্টারের মধ্যে সংযোগকারী সড়ক। আমাদের দেশে ট্রেন চলাচলের জন্য যেমন রাস্তার উভয় পাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনিই বিমান আকাশে ওড়ার সময় সেখানে দুই পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই এখানে ট্রাফিক সংকেত মানা অপরিহার্য। আর তা না হলে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। তা ছাড়া বিমানবন্দরের সঙ্গেই রয়েছে বিশালাকৃতির উঁচু জিব্রাল্টারপাহাড়। আর তাই ওঠানামার সময় নিতে হয় বাড়তি সতর্কতা।
Post a Comment