বাংলা ভাষা সম্পর্কে আপনি যেটা জানেন না


Odd বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা ভাষা এক অতি সমৃদ্ধশালী ভাষা। ভাষার মূল সম্পদ শব্দ। শব্দ-সম্পদে যে ভাষা যত সমৃদ্ধ, সে ভাষা তত উন্নত ও উৎকর্ষম-িত। মানুষের মনের বিচিত্র ভাব প্রকাশের জন্যও তা বিশেষ উপকারী। বাংলা ভাষার শব্দসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার। বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে ভাষাতাত্ত্বিক ও বৈয়াকরণিকগণ চারভাগে বিভক্ত করেছেনÑ ১. দেশী, ২. তদ্ভব, ৩. তৎসম ও ৪. বিদেশী। বলাবাহুল্য, বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচিত হয় সংস্কৃতপ-িত ও বহিরাগত ইংরাজদের হাতে। তাঁরা বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ হিসাবে প্রমাণ করতে গিয়ে এ ধরনের অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হন। পরবর্তীকালের গবেষকগণ পূর্ববর্তীদের ধারণা সম্পর্কে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন বলে মনে হয় না। 

পৃথিবীর তাবৎ ভাষাসমূহে তিন শ্রেণির শব্দ রয়েছেÑ ১. মূল ভাষার আদি শব্দসমূহ, ২. কালক্রমে আদি শব্দসমূহের রূপান্তরিত রূপ, ও ৩. নানাভাবে মূল ভাষায় আত্তীকৃত বিদেশী শব্দসমূহ। যেগুলোকে এককথায় দেশী শব্দ, রূপান্তরিত ও বিদেশী শব্দ বলা যায়। 

বাংলা ভাষায়ও আদিকাল থেকে এ তিন শ্রেণির শব্দ রয়েছে। দেশী শব্দ, যা স্বদেশের মাটি ও ভূমিপুত্রদের (অথবা ভূমিকন্যা) মুখের ভাষা। রূপান্তরিত শব্দ মূল শব্দ থেকে উদ্ভূত। মূলত পৃথিবীর সব ভাষার শব্দরাজিই কালক্রমে রূপান্তরিত হয়। রূপান্তর বা বিবর্তন প্রকৃতির মধ্যে যেমন ভাষা ও শব্দের মধ্যেও তেমনি এক অনিবার্য বাস্তবতা। বিদেশী শব্দের সংযোজন ও আত্তীকরণ ঘটে নানা কারণে। বহিরাগতদের আগমনে, দেশীয় লোকেরা যখন বিদেশে যায়, তখন বিদেশীদের সাথে মেলামেশার ফলে এবং বৈদিশিক সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম ইত্যাদির মিশ্রণ বা প্রভাবে। বাংলা ভাষায়ও ঠিক এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে ভাষার মধ্যে নানাভাবে মিশ্রণ, গ্রহণ-বর্জন, আত্তীকরণ ইত্যাদি ঘটেছে। রাজ্যজয়, ধর্মীয় প্রচার, বিজ্ঞান-সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের ফলে বাংলা ভাষায় যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের মিশ্রণ ঘটেছে। এভাবেই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, তুর্কি, উর্দু, ইংরাজি, ফরাসি, পর্তুগীজ ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার শব্দরাজি বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে। 

তবে সব ভাষা থেকে একইভাবে বা সমসংখ্যক শব্দ এসেছে, তা নয়। সংস্কৃত ভাষা থেকে আত্তীকৃত শব্দরাজির সংখ্যা সর্বাধিক। এগুলোকে ‘তদ্ভব’ ও ‘তৎসম’ নামে অভিহিত করা হয়। এদেশে দীর্ঘকাল হিন্দুদের রাজত্ব চলে। হিন্দুধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ ও ‘মহাভারত’ সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সেন রাজাদের আমলে সংস্কৃত ছিল রাজ-পরিবার, রাজ-দরবার ও পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের ভাষা। বাংলার শাসন, ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের আধিপত্য বজায় থাকায় দেশীয় বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রবল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে সংস্কৃত ভাষা থেকে অসংখ্য শব্দ বাংলায় আত্তীকৃত হয়েছে দীর্ঘকাল যাবৎ। 

মুসলিম শাসনামলে আরবি-ফারসি-তুর্কি-উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্ল¬াহ্র মতে প্রায় তিন হাজার এ জাতীয় শব্দ বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়। সংখ্যার দিক থেকে সংস্কৃতের পরেই এর স্থান। ইংরাজ আমলে ইংরাজি, ফরাসি, পর্তুগীজ ইত্যাদি ভাষার শব্দরাজি বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিশ্বের সাথে আমাদের বিভিন্ন কারণে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় অসংখ্য বিদেশী শব্দ প্রতিনিয়তই বাংলা ভাষায় আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে। যেকোন ভাষার ক্ষেত্রে এটা একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। এভাবে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। এটাকে বলে ভাষার প্রবাহমানতা বা চলমানতা। যেকোন জীবন্ত ভাষার ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। যে ভাষার স্বীকরণ বা আত্তীকরণ ক্ষমতা যত অধিক সে ভাষা তত জীবন্ত ও সমৃদ্ধ। এদিক দিয়ে বাংলা ভাষা পৃথিবীর সমৃদ্ধতম ভাষাসমূহের অন্যতম। 

বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ত্যাগ ও সংগ্রাম পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সে কারণে বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা হিসাবে বাংলা আমাদের পরম গৌরবের। তাই বাংলা ভাষার সঠিক ইতিহাস রচনা, বাংলা ভাষার যথাযথ চর্চা এবং বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবী।   

বাংলা ভাষার মত বাংলা সাহিত্যও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নোবেল পুরস্কার’ পেয়েছেন। মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁদের মত আরো অনেক বিশ্বমানের কবি-সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা করে কালজয়ী খ্যাতি অর্জন করেছেন। ফলে বাংলা সাহিত্য আজ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধতম সাহিত্য। অবশ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন নয়। বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসনামলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। ঐ সময় চর্যাপদ ও দোহা নামে সাহিত্যের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তা থেকে অনুমান করা চলে যে, বাংলা সাহিত্যের বয়স সর্বাধিক দেড় হাজার বছর। কিন্তু চর্যাপদ বহুদিন কালের বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল। বাংলাদেশে সেন আগমনের পর বৌদ্ধ পাল রাজাগণ ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর বিদ্বিষ্ট সেন শাসকগণ বৌদ্ধদেরকে হত্যা অথবা দেশত্যাগে বাধ্য করে। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, ভাষ্কর্য ইত্যাদি সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পলায়নপর বৌদ্ধদের কেউ হয়তো ‘চর্যাপদ’ ও ‘দোহার’ উক্ত পা-ুলিপিটি সঙ্গে করে নেপালে নিয়ে গিয়েছিলেন। প-িত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সেখান থেকে এ পা-ুলিপিটি উদ্ধার করেন ১৯০৭ সালে। ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্য কোন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি। 

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর সুলতানী আমলে (১৩৩৮-১৫৫৭) রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত ‘বেদ’ ও ‘মহাভারত’ বাংলায় অনূদিত হয়। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত ‘ÔHistory of the Bengali Language and Literature’’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯১১) নামক গ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে শাহ মোহাম্মদ সগীর রচিত ‘ইউসুফ জুলেখা’ গ্রন্থের কথা উলে¬খ করেন। এটি রচিত হয় ফারসি ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্যের অনুসরণে। এরদ্বারা প্রমাণ হয় যে, বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক পর্যায়ে ফারসি সাহিত্যের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এ তথ্যের ভিত্তিতে বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে নতুনভাবে গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়। 

মুসলিম আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। দেশী ও সংস্কৃত তদ্ভব-তৎসম শব্দের সাথে অসংখ্য আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দ যুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা সুসমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে আরবি ও ফারসি সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধিও নিশ্চিত হয়। মধ্যযুগের অনেক কিছু সম্পর্কেই আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা নেই, ক্ষেত্র বিশেষে বিকৃত ও অসত্য বিষয় ভিত্তি করে আমাদের ইতিহাস রচিত হয়েছে। এ সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ ইতিহাস তুলে ধরা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবী। কেননা, যেকোন জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য সর্বদা অনুপ্রেরণা যোগায়। 
Blogger দ্বারা পরিচালিত.