স্বামীকে খেয়েছে বাঘে, আমাকে খাচ্ছে সমাজ


Odd বাংলা ডেস্ক: ছেড়ে গেছে সন্তানেরা, বর্জন করেছে প্রতিবেশীরা। তার তকমা জুটেছে ‘অলক্ষ্মী’ হিসেবে। কিন্তু মোসাম্মৎ রাশিদার অপরাধ? অপরাধ তার স্বামীকে বাঘে খেয়েছে! সুন্দরবনের বাঘের হাতে স্বামীর প্রাণ হারানোর ‘দায়’ এই প্রৌঢ়াকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বছরের পর বছর।

রাশিদার মতোই দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এমন হাজারো নারী বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বামীর ‘দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি’র কারণ হিসেবে ‘অলক্ষ্মী’ বা ‘হতভাগী’ অপবাদ। এই অপবাদ মাথায় তাদের যাপন করতে হচ্ছে চরম মানবেতর জীবন।

রাশিদার বাড়ি সুন্দরবনের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামে। মধু আহরণকারীদের এই গ্রামে নিজের জীর্ণ কুঁড়েঘরে কাতর স্বরে রাশিদা বলছিলেন তার দুঃখগাথা, ‘সবাইতো মুখ ফিরিয়ে নিলোই, আমার ছেলেরাও আমায় বলল, আমি নাকি অলক্ষ্মী! তারাও আমায় ছেড়ে গেল!’

গাবুরা গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে মধু আহরণে গিয়েছিলেন রাশিদার স্বামী। আকস্মিক রয়েল বেঙ্গল টাইগার আক্রমণ করে তাকে। মানুষখেকো ওই বাঘের থাবায় প্রাণ হারান তিনি।

স্বামীকে হারানোর পর রাশিদার ২৪ ও ২৭ বছর বয়সী দুই সন্তানও তাকে ছেড়ে চলে যায়। চোখের জল মুছতে মুছতেই ৪৫ বছর বয়সী রাশিদা বলেন, ‘সবশেষে তারাও আসলে সমাজেরই অংশ।’

তিনি যে ছোট্ট খুপরি ঘরে থাকেন, সেটার চালাও নেই। একবার এক ঘূর্ণিঝড়ে সেই চালা উড়ে গিয়েছিল। তখন গ্রামবাসীর সাহায্য চাইলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।

ঘূর্ণিঝড়ের পর গ্রামের অনেকে সরকারি সাহায্য পেলেও বঞ্চিত হন রাশিদা। তবে এই স্বামীহারা নারীর সাহায্যবঞ্চিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেন সরকারি কর্মকর্তারা।

‘বাঘ-বিধবা’দের এমন অবজ্ঞার চোখে দেখার সংস্কার সুন্দরবনের গোঁড়া রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোতে দেখা যায়। অনেক সম্প্রদায় এই কুসংস্কার লালন করছে শতবছর ধরে।

 ‘বিধবাদের মর্যাদা পুনর্প্রতিষ্ঠায় কাজ করে চলেছে দাতব্য সংস্থাগুলো। কিন্তু এখানে বড় অন্তরায় হলো মানুষের বিশ্বাসের পরিবর্তন করা। এই বিশ্বাস বদলের গতি খুবই ধীর। 

রাশিদার মতো আরেক ‘বাঘ-বিধবা’ রেজিয়া খাতুন। ১৫ বছর আগে তার মধু আহরণকারী স্বামীকে বাঘে খেলে রেজিয়াকেও ‘হতভাগী’ অপবাদ দেয়া হয়। তবে তিনি ধীরে ধীরে সামলে ওঠেন। রেজিয়াকে জীবনে স্বাভাবিক করতে সমাজের মানুষের আড়ালে গোপনে সহায়তা করে আসছেন তার ভাগনে ও অন্য আত্মীয়রা।

রেজিয়া বলছিলেন, ‘তিনি (স্বামী) মারা যাওয়ার সময় আমার ছেলেরা খুব ছোট্ট ছিল। কেউ আমাকে তখন সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল না। তারা স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করছিল বিধায় প্রথম দিকে আমার খারাপ লাগতো, কারণ আমি জানতাম না যে আমার অপরাধ কী। এখন আমি এই দুর্দশার মধ্যেই বেঁচে থাকার লড়াই শিখে গেছি।’

রেজিয়ার ভাগনে ইয়াদ আলী তার মামাসহ অনেক মধু আহরণকারীর ওপর বাঘের আক্রমণ নিজ চোখে দেখেছেন। তার মামা মারা যাওয়ার পর সমাজের লোকজনের আচরণও দেখেছেন মামীর ওপর। তাই অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি মামীর জন্য এগিয়ে আসেন।

ইয়াদ আলী বলছিলেন, ‘আমরা তার জন্য কিছু (রেজিয়াকে সাহায্য) করতে গেলেও গোপনে করতে হতো। নইলে সমাজ আমাদেরও এক ঘরে করে ফেলতো।’

২১ বছর বয়সী হারুন অর রশীদের বাবাকেও বাঘের থাবায় প্রাণ দিতে হয়েছিল। মধু আহরণ তাদের বংশ পরম্পরার পেশা হলেও হারুন তা বদলে নেমেছেন মাছ ধরায়।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.