দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন: মহামারি ঠেকাতে নিজেদের গৃহবন্দি করেছিল একটা গোটা শহর


ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, Odd বাংলা: সাল ১৬৬৫-'৬৬। দ্য গ্রেট প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত হয় লন্ডনের এক ছোট শহর। কয়েক শো মানুষের সমবেত সিদ্ধান্তে ছড়িয়ে পড়ার হাত থেকে বেঁচেছিল এক মারত্মক মহামারি। মহামারীর কবল থেকে পালানোর পরিবর্তে আক্রান্ত মানুষরা নিজেদের কার্যত গৃহবন্দী করে নিয়েছিলেন। যার ফলে মহামারিটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। 

সবকিছু শুরু হয়েছিল কাপর থেকে। ১৯৬৫ সালে লন্ডনের এক ব্যবসায়ী ইংল্যান্ডের ইয়ম নামে একটি ছোট শহর তথা গ্রামের দর্জির কাছে এক বান্ডিল কাপড় পাঠায়। ওই কাপড়ের বান্ডিল থেকে আগে থেকেই সংক্রমিত ছিল মারণ রোগের উপাদান। কাপড়ের বান্ডিলটি যখন এসে পৌঁছায় তখন সেই দর্জির সহকারী সেই কাপড়ের বান্ডিলটি খুলে দেখেন সেগুলি কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে। আর সেই কারণেই তিনিন কাপড়গুলিকে আগুনের সামনে শুকনো করতে বিছিয়েছিলেন। তিনি খেয়ালই করেননি যে তার মধ্যে নীলমক্ষি (এক প্রকার মাছি) বাসা বেঁধেছিল, সেই মাছিগুলি কোনও কারণে প্লেগ আক্রান্ত ইঁদুরকে কামড়েছিল আর সেইকারণেই যেগুলি বুবোনিক প্লেগের ব্যাকটেরিয়া বহন করছিল। এইভাবেই প্রথমে একজন, সেখান থেকে দু'জন-চারজন করে ছোঁয়াছুঁয়িতে প্লেগের কবলে পড়েছিল একটা গোটা গ্রাম! 

এইভাবে একের পর এর আক্রান্ত হওয়ার পরে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল গ্রামবাসী। তাঁদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল যে, নিজেদের বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালাবেন সকলে। কিন্তু তাঁদের এই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেছিল দুই স্থানীয় জাজক উইলিয়াম মোম্পেসন এবং থমাস স্ট্যানলি। প্রথমে সকলে একমত না হলেও পরে সকলের সমবেত সিদ্ধান্ত মেনে, শহরের প্লেগের প্রাদুর্ভাব না কমা পর্যন্ত শহরের মূল ফটকগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং আক্রান্তরা নিজেদের একপ্রকার শহরবন্দি করে ফেলেন। ওই দুই ধর্মীয় যাজক আসলে চেয়েছিলেন মারণাত্মক এই রোগকে প্রতিরোধ করতে। তাঁরা ভেবেছিলেন এই আত্মত্যাগের মূল্য ঈশ্বর তাঁদের অবশ্যই দেবেন। 
এইভাবেই পার্শ্ববর্তী সমস্ত শহরের থেকে ধীরে ধীরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে ইয়ম। এদিকে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে একের পর এক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। খাবার, জল এবং অন্যান্য একান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী গ্রামাঞ্চল থেকেই সরবরাহ করা হত। গ্রামের আদী বাসিন্দা যারা তাদের ৩৫০ জনের মধ্যে বেঁচেছিলেন মাত্র নব্বই জন।

তবে এই মহামারীটি লন্ডন থেকে ইওরোপের একধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তবে কেউ ইয়ম গ্রামের মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আর এই কারণেই এই গ্রামের ত্যাগ স্বীকারের কাহিনি আজও ভোলেনি ইতিহাস। দ্য গ্রেট প্লেগ বা বুবোনিক প্লেগ মধ্যযুগীয় ইওরোপে এক ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। এটি আবার ব্ল্যাক ডেথ নামেও পরিচিত ছিল কারণ এর ফলে আক্রান্তের ত্বকে কালো কালো ছোপ সৃষ্টি হত। পাশাপাশি চামড়া কুঁচকে যাওয়া, বগলের ফোলাভাব বা গ্ল্যান্ড, বমি ভাব, মাথা ব্যথা চলতে চলতে রোগী একসময়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। 

এই রোগটি প্রথম মহামারীর আকার ধারণ করেছিল ১৩৪৬ এবং ১৩৫৩ সালে। পরবর্তীকালে বুবোনিক প্লেগ ফের থাবা বসিয়েছিল লন্ডনে ১৬৬৫-'৬৬ সালে। যদিও চোদ্দ শতকের প্রাদুর্ভাবের চেয়ে এর আকার অনেক ছোট ছিল, তবুও এটি কেবল লন্ডনেই এক লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল! জানা যায় এই মহামারি চলাকানীন প্রতিবেশি গ্রামের কাছ থেকে সাহায্য এসেছিল। শহরের উপকণ্ঠে মাংস, শস্য এবং অন্যান্য সামগ্রীর পার্সেল পাঠানো হত। এর পরিবর্তে ইয়মের মহামারি আক্রান্তরা একটি বাটিতে ভিনিগারের মধ্যে পয়সা ডুবিয়ে রেখে দিত। সেই সময়ে ভিনিগার একটি মারাত্মক জীবাণুনাশক হিসাবে কাজ করেছিল। বলা হয় এর নজির আজও সেই গ্রামে গেলে পাওয়া যায়।
অন্যান্য শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও, গ্রামবাসীরা গ্রামের মধ্যে সংক্রমণের বিস্তারকে হ্রাস করার পদক্ষেপও নিয়েছিল। গ্রামের গির্জাটিকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যা কবরস্থান থেকে অনেকটাই দূরে ছিল।  সবথেকে বেদনাদায়ক আক্রান্ত পরিবারগুলিকে তাদের প্রিয় জনের মৃতদেহ সমাহিত করতে হয়েছিল। এইভাবে একদিন সেই ধর্মজাজকের স্ত্রীও একদিন মারা গেলেন যিনি গোটা গ্রামকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনও হয়েছিল যে। এমন ঘটনাও ঘটেছিল যে, পরিবারের একজনই তাঁর গোটা পরিবারকে কবরে সমাহিত করেছিল! শুধু তাই নয় মৃত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এড়ানোর জন্য মৃতের পায়ে দড়ি বেঁধে দেহগুলিকে রাস্তায় টেনে আনা হত।

এর ১৪ মাস পরে, প্লেগটি হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়. ততদিনে কার্যত ছাড়খাড় হয়ে গিয়েছে সবকিছু। তবে আজও এই গ্রামে এলে পর্যটকরা এই মহামারিতে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পয়সা দেন। এই ঘটনা একটা বার্তাই দিয়েছিল যে, মহামারির সময় মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধে স্থান পায় সামাজিক মূল্যবোধ। নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি অন্য মানুষ যাতে সুরক্ষিত থাকেন সেই শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছিল ইময়ের মানুষরা।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.